• ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ছাতকের ঘানোউড়া নদী- বর্ষায় নৌকা হেমন্তে বাঁশের সাঁকোই গ্রামগুলোর ভরসা

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত মার্চ ২৮, ২০২২
ছাতকের ঘানোউড়া নদী- বর্ষায় নৌকা হেমন্তে বাঁশের সাঁকোই গ্রামগুলোর ভরসা

নিজস্ব প্রতিবেদক: সুনামগঞ্জের ছাতকে ঘানোউড়া নদীতে একটি সেতুর অভাবে ৯টি গ্রামের বাসিন্দারা চরম দূভোর্গ পোহাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে ওই নদীতে সেতু নির্মাণের দাবি করে আসলেও পূরণ হচ্ছেনা। স্বাধিনতার পঞ্চাশ বছরেও এ নদীতে সেতু নির্মাণ না হওয়ায় জনমনে অসন্তোষ বিরাজ করছে। হেমন্তে বাঁশের সাঁকো আর বর্ষায় খেয়া নৌকায় জীবনের ঝুকি নিয়ে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীসহ এলাকার প্রায় ৮হাজার মানুষ চলাচল করছেন। সেতুর অভাবে অসুস্থ রোগিদের দ্রুত কোন হাসপাতালে নেয়া সম্ভব না হওয়ায় প্রায় সময় ঘটছে দূর্ঘটনা। জেলা ও উপজেলা সদরের সাথে তাদের সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তাদের দু:খ কষ্টগুলো দেখার যেন কেউ নেই।
জানা যায়, ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের চৌকা ও অলিগঞ্জবাজার এর মধ্যখানে রয়েছে ঘানোউড়া নামের একটি নদী। চৌকা পয়েন্ট থেকে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে পাকা রাস্তার শেষ মাথায় মিলে এ নদী। নদীর অপারে রয়েছে অলিগঞ্জ নামের ছোট্র একটি গ্রাম্য বাজার। ওই বাজার থেকে সংস্কারবিহীন কাঁচা রাস্তায় সংযোগ রয়েছে খরিদিচর-টেটিচর গ্রামের সাথে। ওই কাঁচা রাস্তার উপর অনেকেই ঘর-বাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন। জাউয়া-আন্ধারীগাঁও হয়ে ছাতক পর্যন্ত রয়েছে আঞ্চলিক সড়ক। ওই সড়কের সাথে খরিদিচর নামক স্থানে সংযোগ রাস্তাটি মিলিত হয়েছে ঘানোউড়া নদী হয়ে চৌকা পয়েন্ট পর্যন্ত। ঘানোউড়া নদীতে সেতুসহ মাত্র চার কিলোমিটার পাকা রাস্তা হলে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দূভোর্গ লাঘব হতো। পূরণ হতো তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। যোগাযোগ ব্যবস্থার এক উজ্জল দৃষ্ঠান্ত হয়ে থাকতো। ঘানোউড়া নদীর উত্তর পাড়ে রয়েছে হরিশ্বরণ, রামচন্দ্রপুর, হাতধলানী, পুরাকাটি, নোয়াগাঁও, রাখা, রসুলপুর, রাউতপুর, ধনপুর, নোয়াগাঁওসহ আশপাশ অনেকগুলো গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। তাদের যাতায়াতের রাস্তা নেই বল্লেই চলে। পায়ে হেটে খরিদিচর অথবা চৌকা পয়েন্ট আসলে তাদের গাড়ির দেখা মিলে। তারা ঘানোউড়া নদী পার হয়ে চৌকা পয়েন্ট দিয়ে যেতে হয় জেলা-উপজেলাসহ রাজধানী ঢাকায়। বর্ষায় নৌকা আর হেমন্তে পায়ে হেটে দীর্ঘপথ চলতে হয় তাদের। এ দূভোর্গের যেন শেষ নেই। এক সময় পুরো চরমহল্লার আঠারোচরসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ঘানোউড়া নদী পার হয়ে পায়ে হেটে চৌকা পয়েন্ট থেকে গাড়ি যোগে ছাতক, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। সম্প্রতি জাউয়া-আন্ধারীগাঁও-ছাতক সড়ক হওয়ায় চরমহল্লাসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ ওই পথে চলাচল করছেন। কিন্তু হাতধলানী, পুরাকাটি, হরিশ্বরণসহ কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ এখনো রয়েছেন অবহেলায়। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ নদীতে একটি সেতুর অভাবে চরম দূর্ভোগে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে এলাকার মানুষকে। প্রতিদিন খেয়া ও সাঁকো পারাপার হয়ে চলতে হয় তাদের। বর্ষায় খেয়া নৌকা আর হেমন্তে সাঁকোই তাদের পারাপারে একমাত্র ভরসা। স্বাধিনতার পঞ্চাশ বছর পার হলেও তাদের দাবি কেউ পূরণ করেনি। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের কষ্ট যেন জীবন সঙ্গী হয়ে দাড়িয়েছে। সেতুটি তৈরি করে দিতে জনপ্রতিনিধিদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়ে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। শুধু আশার গল্প কাহিনী শুনতে হচ্ছে তাদের। এমন অভিযোগ ওই এলাকার মানুষের। সেতু নির্মিত হলে পুরো চরমহল্লার আঠারোচরসহ এবং এ অঞ্চলের মানুষ চৌকা পয়েন্ট হয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জসহ সারা দেশের সাথে কম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। জনস্বার্থে সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কতর্ৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
সরজমিন ঘুরে এলাকার জহুর আলী, কলিম উদ্দিন, ইউনুস আলী, গোলাম মর্তুজা, আবদুল মতিনসহ হরিশ্বরণ, হাতধলানী, পুরাকাটি, রামচন্দ্রপুরসহ আশপাশ গ্রামের মানুষের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ছাতক-দোয়ারাবাজার আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ঘানোউড়া নদীর উত্তর পাড়ে অলিগঞ্জবাজারে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই সংবর্ধনায় সাংসদের কাছে নদীতে সেতু নির্মাণের দাবি তুলেন ভূক্তভোগি এলাকাবাসী। এর প্রেক্ষিতে তিনি এলাকাবাসীকে আশ্বস্থ করেছিলেন কিন্তু আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া নদীর উত্তর পাড়ে একটি হাইস্কুল নেই। যে কারণে ছেলে-মেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ষায় খেয়া, হেমন্তে সাঁকো পার হয়ে চেচান সিপিবি হাইস্কুল, জাউয়া ও গোবিন্দগঞ্জ কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। হেমন্তে পানি শুকিয়ে নদীর তলায় চলে গেলে বাঁশ দিয়ে সাঁকো তৈরি করে দিয়ে ওই সাঁকাই তারা পারাপার হন। বৃষ্টি নামলেই মানুষ সাঁকো দিয়ে পারাপারে অনেক কষ্ট হয় নদীর তীর পিচ্ছিলের কারণে। বয়স্ক মানুষ এদিকে চলতে পারেন না। নদীর দক্ষিণ পাড়ের চৌকা, হলদিউড়াসহ আশপাশ গ্রামের মানুষের ক্ষেতের জমি নদীর উত্তর পাড়ে থাকায় তাদের গৃহপালিত গরু নিয়ে সেখানে হাল-চাষ করেন। হালের গরু নদী দিয়ে এবং ক্ষেতের উৎপাদিত ফসল খেয়া ও সাঁকোই বহন করতে হয় তাদের। জুবায়ের আহমদ ও ফাহিম আহমদ বলেন, অনেক কষ্ট করে তারা চেচান সিবিপি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করছেন। বর্ষায় তাদের অনেক সহপাঠিরা ওই নদীর পানির ভয়ে প্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনা। নদীতে সেতুটি স্থাপন হলে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে যেতে অনেক আগ্রহ বাড়বে এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হবে। প্রায় ২০ বছর ধরে ঘানোউড়া নদীতে খেয়া নৌকায় এলাকার মানুষকে পারাপার করে আসছেন শান্তিগঞ্জের পাগলা এনাতনগরের মনু মিয়া। তিনি বলেন, তার সাথে রয়েছেন রামচন্দ্রপুর গ্রামের অধির চন্দ্র দাস। দু’জন মিলেই তারা বর্ষায় খেয়া নৌকা আর হেমন্তে বাঁশ দিয়ে সাঁকো তৈরি করে মানুষকে পারাপার করেন। নৌকা ও বাঁশ দিয়ে তাদের সহযোগিতা করেন এলাকাবাসী। এলাকার লোকজনের কাছ থেকে পারাপারে কোন টাকা না নিলেও বছর শেষে বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান সংগ্রহ করেন। কিন্তু বাহিরের লোকজনকে পারাপার করে জনপ্রতি তারা ৫টাকা হারে নিচ্ছেন।
চৌকা গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাদাত মো. লাহিন মিয়া বলেন, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই ছাতকে সীমাহীন উন্নয়ন হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ঘানোউড়া নদীতে ও ঢাকাইপীরের মাজার সংলগ্ন খালের উপর পৃথক দু’টি সেতুর অনুমোদনের জন্য প্রায় দুই মাস আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই দরপত্রের মাধ্যমেই সেতুর কাজ শুরু হবে। উপজেলা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল মনসুর মিয়া জানান, প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য এলজিইডি সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই দরপত্র আহবানের মাধ্যমে সেতুর অনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে।