• ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

আল্লামা ছালিক আহমদ রহ.কে নিয়ে স্মৃতিকথা

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত জুলাই ১, ২০২১
আল্লামা ছালিক আহমদ রহ.কে নিয়ে স্মৃতিকথা

প্রাণপ্রিয় উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা ছালিক আহমদ রহ. হুজুরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে চাইলেও বাঁধ ভাঙা অশ্রু সংবরণ করা সম্ভব হয়না। মাঝে মাঝে অন্য মনস্ক হয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি। হুজুরের ইন্তেকালের পরদিন শুক্রবারে জুমআর আলোচনায় ইচ্ছা ছিল হুজুরের পরিচয় দিয়ে মুসল্লীদের নিয়ে দোয়া করবো। কিন্ত “গতকাল আমার মুহাদ্দিস সাব হুজুর ইন্তেকাল করেছেন ” অংশটুকু বলার পরে কলিজায় মোচড় দিয়ে চোখে যে অশ্রু ধারা শুরু হয়েছিল নামাজ পড়ানোর মত কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট থাকেনি।

আমি ২০০৭ সালে সৎপুর কামিল মাদরাসায় আলিম জামাতে ভর্তি হই। তখন আরবি সাহিত্যের আদব অংশ পড়াতেন মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর। মাদরাসায় কমিউনিকেটিব আরবী তখনো আসেনি। কিন্তু হুজুরের পাঠদান কালীন সময়ে ব্যাকরণের যে ব্যবহার দেখিয়েছিলেন, তা কমিউনিকেটিব আরবী আসার পরেও অন্য কারো দ্বারা ততটা সমৃদ্ধি পাঠদান চোখে পড়েনি।

আলিম ২য় বর্ষে আদব পড়ার সময় একদিন প্রসঙ্গক্রমে ইসমে মুরাব এর আলোচনা চলে আসলো। এক এক করে হুজুর সকলকে জিজ্ঞেস করলেন ইসমে মুরাবের প্রকার ও তাতে ইরাবের ব্যবহার সম্পর্কে। সেদিন সম্পূরক উত্তর কেউ দিতে পারেনি। তবে আমি মোটামুটি গোছালো একটা জবাব দিয়েছিলাম। সেদিন হুজুর মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলেন “মনযোগ দিন পড়লে তুই কাজে লাগবে”। এই মুচকি হাসির প্রেরণা জীবনে বিরাট শক্তির যোগান দিয়েছে।

হুজুরের আখলাক সম্পর্কে বলার মতো যোগ্যতা সাহস কোনটাই আমার নাই। সংক্ষেপে এতটুকু বলতে পারি মোস্তাহাব কোনো আমলও সহজে কোনোদিন ছাড়তেন না। আর সুন্নাততো ছিলো হুজুরের নিত্য সঙ্গী। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের এই দীর্ঘ সময়ে যতদিন খেয়াল করেছি যোহরের ওয়াক্তে কোনোদিন মেসওয়াক করা বাদ পরেনি। যোহর নামাজের পরে ছাত্রদের নিয়ে হুজুর নিয়মিত খতমে খাজেগান পাঠ করতেন। এসময় হুজুর নির্ধারিত তাসবীহগুলো যে আবেগ মিশ্রিত মধুমাখা সুরে তিলাওয়াত করতেন সেই শ্রুতিমধুর আওয়াজ আমার জীবনে আর কারো মুখে শুনিনি। সেই তাসবীহগুলোর একটি ছিলো اللهم يا ولي الحسنات. এই তাসবীহখানা আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিলো যে আমিও আজ পর্যন্ত কোথাও খতমে খাজেগান পাঠ করলে কোনো দিন ভুলিনা। আর যখন আমি এই তাসবীহখানা পাঠকরি আমার হুজুরের মোবারক চেহারা হৃদয়ে ভেসে উঠে।

হুজুরের কোন গুন নিয়ে আলোচনা করবো আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে। সৎপুর ভর্তি হওয়ার পরে আমাকে আকৃষ্ট করলো হুজুরের ওয়াজ মাহফিলের আলোচনা। উপস্থাপিত যেকোনো বিষয় দালিলিক আলোচনায় এতো স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করে দিতেন ব্যাপারটি নিয়ে জিজ্ঞাসা করার কিছু বাকি থাকতো না। আমার জীবনে হুজুরের আলোচনা যতটা প্রভাব ফেলেছে আর কারো ওয়াজ দ্বারা তত প্রভাবিত হইনি। হুজুরের আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা, খাওফে এলাহি, হুব্বে রাসূল, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা, হালাল-হারাম, সমসাময়িক আবির্ভুত নতুন বিষয়ে শরীয়তের ফয়সালা, ভন্ড বিদয়াতীদের পরিচয় ও সমাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি। বৃহত্তর সিলেটে ওয়াজের ময়দানে ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলার আওলাদগণের পরে মূল আলোচক ছিলেন আমার হযরত মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর। সুদূর অতীতে বৃহত্তর সিলেটে খ্যাতনামা বক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন শায়খুল হাদীস হযরত মাওঃ রইছ উদ্দিন হামজাপুরী (রাহ.)। যার আলোচনায় মানুষ কতটা মুগ্ধ হতো প্রায় দুই যুগ গত হলেও সে সময়ের শ্রোতাগণ সেই স্মৃতিচারণে আজো অশ্রু ঝরান। এলাকার বিজ্ঞজনেরা বলতেন আল্লামা ছালিক আহমদ সাহেব সেই শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। আল্লাহ পাক আজ তাকেও উঠিয়ে নিয়েছেন। আরেকজন শায়খুল হাদীস দিয়ে আমাদের উপর রহম করো ইয়া রব।

মাঝেমধ্যে হুজুর মাযাহ (বাস্তব কৌতুক) করতেন। একবার আমার গ্রাম হাউসায় মাওলানা আব্দুল কাদির লন্ডনী সাহেবের বাড়িতে খতমে বুখারীর মাহফিল হলো। মহফিল শেষে হুজুরকে আমার বাড়িতে নেওয়ার জন্য বললাম ” হুজুর নদী পার হলেই আমার বাড়ি, যদি একটু কষ্ট স্বীকার করিলিতা।” হুজুর বলেছিলেন ” নিতেনা করি আগে নদী দেখাইরে। আগে নদী দেখাইলে আর যাইমু কিলা।”

বেশ স্নেহ করতেন আমাকে। ২০১৪-১৫ সেশনে আমাকে সৎপুর কামিল মাদরাসার ছাত্র সংসদের জি.এস মনোনীত করা হয়। ফলে হুজুরের খুব নিকটে পৌঁছে গেছিলাম। সে-সময় ফাজিল পরীক্ষার্থী চারজন ছাত্র আমাকে শোনাচ্ছিলেন তাদের পরীক্ষা ফি সম্পূর্ণ মিলাতে পারে নাই। আমি তাদের অবস্থা মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরকে শোনায়েছিলাম। হুজুর তৎকালীন প্রিন্সিপাল হযরত মাওলানা শফিকুর রহমান(মাঃ আঃ) সাহেবের কাছে সুপারিশ করে তাদের পরীক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন। তাছাড়া ঐ বছর হুজুরের বাড়ীর (ভুরকী) বার্ষিক মাহফিলে আমাকে ছাত্র নাজিম হিসেবে দাওয়াত দিয়েছিলেন।

কামিল জামাতে পড়ার সময় আমরা সাত বা আটজন ছিলাম নিয়মিত ক্লাস করতাম। আমি নিয়মিত হাদিস পড়তাম। মনে আছে একদিন বাসায় শারহু মায়ানিল আছার পড়তে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ইবারতের তাশকিল ঠিক করতে পারছিলামনা। পরদিন ক্লাশে হুজুর আমাকে বললেন পড়। আমি পড়তে শুরু করে পুরো বাব শেষ করছি ইরাবে কোনো ভুল হয়নি। সেদিন আমি বুঝেছিলাম হুজুরের রুহানি শক্তি কতটা শক্তিশালী। আমাদের সময় কামিলে আমরা দুই তিনজন ছিলাম দরসকালীন প্রয়োজনীয় প্রশ্নোত্তরে অংশ নিতাম। এজন্য আমরা হুজুরের স্নেহের পরশ অনেকটা বেশি পেয়েছি। মনে আছে একদিন দরসে উপস্থিত সবার কাছ থেকে হাদিসের মতন পড়া শুনেছিলেন। সেদিন যাওয়ার সময় হুজুর বলেছিলেন আমি ক্লাশ শেষ করিয়া যাওয়ার পড়ে তোমরা মাহিরে(আমাকে) লইয়া মতন পড়িও।

মাঝে মাঝে ফোন করে অনেক বিষয়ের সমাধান নিতাম, কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি। হুজুরের মাহফিলগুলো ফোনে কথা বলেই নিশ্চিত করা হতো। কেউ কোনোদিন অগ্রিম সাক্ষাৎ করে হাদিয়ার একাংশ জমা দিয়েছে এমন নজির দেখাতে পারবেনা। যা ভাইরাল ওয়াইজরা অভ্যাসে পরিণত করেছে।

হুজুরের ইন্তেকালের আগের রাত দুইটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। অনেক চেষ্টা করেও আর এক মুহুর্তের জন্য ঘুম আসেনি। কয়েকবার হুজুরের কথা স্মরণ হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে সামান্য সালাতও দালাইলুল খাইরাতের নির্দিষ্ট অংশ তিলাওয়াত করি। অতঃপর আজান হয়। নামাজ পড়লাম সাথে কিছু সময় তিলাওয়াত করে হুজুরের সুস্থতার জন্য মুসল্লীদের নিয়ে দোয়া করলাম। অপেক্ষা করছিলাম সকাল আটটার দিকে মাওলানা আব্দুল বাসিত সাহেব হুজুরকে ফোন দিয়ে হুজুরের শারীরিক অবস্থা জানবো। সে সময় আসার আগেই আমার হুজুর রফিকে আ’লার দরবার মিলিত হয়ে আমাদের এতিম করে চিরদিনের জন্য বিদায় গ্রহন করেন।

কী হারালাম আমরা! আহ।

প্রতিনিয়ত কত মৃত্যু সংবাদ শুনি। কিন্তু হুজুরের বিদায়ী সংবাদ আমাকে একেবারে নির্বাক করে দেয়। এই বুকফাটা চিৎকার আজও থামেনি। চোখ বুজলেই হুজুরের আওয়াজ চেহারা সব ভেসে উঠে। নিজেকে শান্তনা দেওয়ার মতো ভাগ্যাকাশে আর কোনো চাঁদ চোখে পড়েনি।

আল্লাহপাক যেন আমার প্রিয় হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ আসন দান করেন এবং হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতায় আমাকে হুজুরের ছাত্র হিসেবে কবুল করেন।

লেখক: মোঃ সেজু মাহি
সহকারী শিক্ষক নরসিংপুর আদর্শ দাখিল মাদ্রাসা
দোয়ারা বাজার, সুনামগঞ্জ।