• ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে হবে:লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের একুশের অনুষ্ঠানে বক্তারা

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে হবে:লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের একুশের অনুষ্ঠানে বক্তারা

বিবিএন ডেস:লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে ‘প্রবাসে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, দেশে-বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে বাংলার প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে বাংলা ভাষায় মূল্য সংযোজন করতে হবে। এর একটা কার্যকর ও ভালো উপায় হচ্ছে- এই ভাষার উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা বাড়ানো বা কার্যকর করে তোলা। আর বিশেষ করে বিলেতে বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শেখাতে হবে। দুইভাবে এই কাজটি করতে হবে। প্রথমতঃ মা-বাবাদেরকে ঘরে সন্তানের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে হবে এবং দ্বিতীয়তঃ বিলেতের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচীতে বাংলা ভাষার অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় লন্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমির সেমিনার হলে মহান একুশে ফেব্রুয়ারী জাতীয় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের আলোচনাপর্বে বক্তারা কথাগুলো বলেন।

‘বাঙালি নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষা শিখাতে আগ্রহী করে তুলতে করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ে বক্তব্য রাখেন দৈনিক প্রথম আলোর সাবেক পরামর্শক সম্পাদক ও বিসিসি বাংলার সাবেক সম্পাদক কামাল আহমদ এবং ‘বিলেতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ে বক্তব্য রাখেন লন্ডনে শহীদ মিনার ও নজরুল সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠা এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল রাজন উদ্দিন জালাল।

ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ। অনুষ্ঠান শুরু হয় এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে। নীরবতা পালনকালে বায়ান্নোর ভাষা শহীদ ও সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হতাহতদেরকে গভীর সহানুভুতির সাথে স্মরণ করে নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস মতে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।

প্রয়াত সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশনের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের মূল কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠানের অতিথি ও ক্লাবের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে গানটি পরিবেশন করেন চ্যানেল এস-এর সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক রুপি আমিন। পরে একুশের গান রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একটি লেখা পড়ে শোনান সিনিয়র সাংবাদিক টিভি উপস্থাপিকা উর্মি মাযহার। দুই অতিথি বক্তার বক্তব্যের ওপর উন্মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ক্লবের সদস্যরা। আলোচনাপর্ব শেষে অনুষ্ঠিত হয় একুশের কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

কামাল আহমদ বলেন, আর্থিক লাভালাভের নিরিখে কোনো ভাষার গুরুত্ব কত, সেটাই এখন বিশ্বে ভাষার প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে। কারণ নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যৎ জীবন-জীবিকার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করাকেই সবচেয়ে জরুরি মনে করে। কোন ভাষায় কত মানুষ কথা বলেন, তার নিরিখে বিশ্বে এক নম্বরে আছে ইংরেজি, যা প্রায় দেড়শ’ কোটি মানুষের ভাষা। সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম অবস্থানটি হচ্ছে বাংলাভাষীদের, যাদের সংখ্যা হচ্ছে ২৭ কোটি। কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ভাষার তালিকায় বাংলা নেই।

তিনি আরো বলেন, দেশে এবং বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে বাংলার প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে বাংলা ভাষায় মূল্য সংযোজন করতে হবে। এর একটা কার্যকর ও ভালো উপায় হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা বাড়ানো বা কার্যকর করে তোলা। একইভাবে শিল্প-সাহিত্যে, সিনেমা-গানে বাংলায় যদি আলোড়ন তোলার মত সৃজনশীল কিছু হয়, তাহলে সেগুলোও অভিবাসী তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারে। বৃটেনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে সরকার দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্কুলে বাংলা পড়ার পিছনে বিনিয়োগ বাড়াবে, তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি বৃটিশ-বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে তোলা দরকার। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার বিকল্প হিসাবে নিজেদেরও উদ্যোগ নেওয়া। বৃটেনেও বাংলা একাডেমির মত কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার যেখানে বাংলা শেখানো, চর্চা ও বিকাশের ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনিস্টিটিউটেরও এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হলে এবং সুযোগ সৃষ্টি হলে ভারতের মত প্রবাসীদের মধ্যে দেশে ফেরার আগ্রহ তৈরি হতে পারে। তবে, সেখানেও শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হলে হবে না, দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরতে হবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন থাকলে চলবে না। কথা বলার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে আগামী প্রজন্ম দেশে স্থায়ীভাবে ফিরতে আগ্রহী হবে না।

রাজন উদ্দিন জালাল বলেন, বিলেতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ ইতিবাচক নয়। আমাদের এই প্রজন্মের মানুষ যখন থাকবেনা তখন বাংলায় কথা বলবে কে? যারা কথা বলবে তারা হলো আমাদের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু তারা তো বাংলা শিখছে না। বাংলার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। তাছাড়া পূর্ব লন্ডনে আভ্যন্তরিন মাইগ্রেশন চলছে। টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে বাংলাদেশীরা বেরিয়ে গিয়ে এখন নিউহ্যাম, বার্কিং এন্ড ডেগেনহ্যাম, হেইভারিং ও এসেক্স এলাকায় বসবাস করতে শুরু করছেন। টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাস ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় মানুষ এখান থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে হলে নজরুল সেন্টারকে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে। অথবা নজরুল সেন্টারের মতো একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে-যেখানে বাঙালিরা প্রতিদিন আসতে না পারলেও অন্তত ছুটির দিনে আসবে এবং ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করবে।

ক্লাব সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, সন্তানদের বাংলা শেখানোর কাজটি আমদের নিজেদের ঘর থেকে শুরু করতে হবে। তাহলে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আমরা দিতে পারবো। তিনি বলেন, এ লেভেলে সাধারণত তিনটি বিষয় শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে। তার মধ্যে তারা যদি বাড়তি বাংলা বিষয়টি নেয় এবং ওই বিষয়ে যদি সে ভালো ফলাফল করতে পারে তাহলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পথ অনেক সুগম হবে। ভালো ইউনিভার্সিটিতে তাঁর পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ বাড়বে।

সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের অন্তত ৭টি স্কুলের ‘ন্যাশনাল কারিকুলামে’ বাংলা ভাষা অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে। একসময় মা-বাবারা তার সন্তানকে স্কুলে বাংলা বিষয়টি নিতে উৎসাহী করে তুলতেন। কিন্তু এখন সেটা খুবই কম। তাছাড়া, অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ কৌশলে বাঙালি শিক্ষার্থীদের বাংলা বিষয় নিতে নিরুৎসাহিত করে থাকে। তাই ঘরে ও স্কুলে বাংলা পড়তে সন্তানদের আগ্রহী করে তুলতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে অভিভাবকদেরকে। তাহলে বিলেতে আরো অনেকদিন বাংলা টিকে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

আলোচনাপর্বের শেষদিকে অনুষ্ঠানের স্পনসর ওয়ার্ক পারমিট ক্লাউডের ফাউন্ডার ও সিইও ব্যারিস্টার লুৎফুর রহমানের হাতে ‘প্রশংসা সনদ’ তুলে দেওয়া হয়।

একুশের কবিতা আবৃত্তি ও গান :: দ্বিতীয় পর্বে ক্লাবের সহকারি সাধারণ সম্পাদক সাঈম চৌধুরী ও নির্বাহী সদস্য নাজমুল হোসেনের যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় একুশের কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

এতে কবিতা আবৃত্তি করেন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সদস্য জিয়াউর রহমান সাকলেন, শহিদুল ইসলাম সাগর, আমিমুল আহসান তানিম, সৈয়দ রুম্মান, রোমান বখত চৌধুরী, মিছবাহ জামাল ও মুনিরা পারভীন এবং লন্ডন সফররত শিক্ষাবিদ শওকত আলী।

মাতৃভাষা বিষয়ক পুঁথি পাঠ করেন চ্যানেল এস এর ক্যাম্ব্রিজ প্রতিনিধি সাংবাদিক মামুন রশিদ। গান পরিবেশন করেন ক্লাব সদস্য ও চ্যানেল এস এর জেষ্ঠ্য সংবাদ উপস্থাপক রুপি আমিন। ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক চৌধুরীর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি ঘটে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি/সাপ্তাহিক দেশ