রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি ডোবা। ডোবার কোণে একটি স্ত্রী-মশা ও একটি পুরুষ-মশার বেড়ে ওঠা। ভাই-বোন সম্পর্ক তাদের। সারাদিন খুনসুটি, ঝগড়াঝাঁটি, কথা কাটাকাটি লেগেই থাকে। দুজনেরই পাখা গজিয়েছে। এখন আর ডোবায় থাকে না। ডাঙায় ঘুরে বেড়ায় যে যার মতো। দিন শেষে দুজনই দেখা করে নির্দিষ্ট একটি স্থানে। একেকজনের একেকরকম অভিজ্ঞতা, একেকরকম গল্প।
স্বভাবতই স্ত্রী-মশার আগ্রহটা মানুষের প্রতি। রক্ত খেয়েই যার জীবনযাপন। সে একবার মানুষের গল্প বলা শুরু করলে, গল্প যেন শেষই হতে চায় না। একটু সুযোগ পেলে স্ত্রী-মশাকে থামিয়ে পুরুষ-মশাও শুরু করে দেয় গাছাগাছালি নিয়ে নানান গল্প-কাহিনি। মানুষের প্রতি মোটেও আগ্রহ নেই তার। সকল আগ্রহ গাছাগাছালিতেই। পাতার রস খেয়ে বেঁচে থাকে সে।
দুজনের ঝুলিতে এত্তএত্ত গল্প। কেউই কারও গল্প শুনতে চায় না। কেবল বলতে চায়। কে বলবে আর কে শুনবে এ নিয়েও কম কথা কাটাকাটি হয় না একে ওপরের মধ্যে।
আজকের ঝগড়াটা একটু অন্যরকম। সমাজে স্ত্রী-মশা, নাকি পুরুষ-মশা বেশি ক্ষতিকর এ নিয়ে। ঝগড়া থেকে সেটি এখন যুক্তি-তর্কে রূপ নিয়েছে।
পুরুষ-মশার অভিযোগ— স্ত্রী-মশা মানুষের রক্ত খায়। ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এতে মানুষরা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সমাজে এটি গ্রহণযোগ্য তো নয়ই বরং নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্যকর কাজ।
জবাবে স্ত্রী-মশা বলল— আমরা না হয় বেঁচে থাকার জন্যে রক্ত খেয়ে থাকি। বংশবিস্তারের জন্যে ম্যালেরিয়া ছড়াই। প্রতিবাদে মানুষ আমাদের তাড়া করে, থাপ্পর দিয়ে মেরে ফেলে। আর তোমরা পুরুষ-মশারা? তোমরা তো নিরীহ-বোবা গাছদের উপর নির্যাতন করো। পাতার রস খেয়ে তাদের দুর্বল বানিয়ে ফেলো। ফলে অল্প বয়সেই প্রাণ হারাতে হয় গাছদের। সমাজে এটিও যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্যকরও বটে।
স্ত্রী-মশার কথা শুনে পুরুষ-মশা নরমস্বরে বলল— বাহ্ রে! আমরাও তো বেঁচে থাকার জন্যে পাতার রস খেয়ে থাকি। কেন? গাছেরা বুঝি কারও ক্ষতি করে না? ওরা তো মাটি থেকে পানি আহরণ করে বেঁচে থাকে। এতে মাটি শুষ্ক হয়ে যায়, গুণাগুণ হারায়।
তখন স্ত্রী-মশা বলল— দেখো ভাই, সমাজের সবাই একে অন্যের ওপর নির্ভশীল। এতে সামান্য ক্ষতি হলেও উপকারই হয় বেশি। এই যে ধরো মানুষের কথাই বলা যায়। ওরা গাছের ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে যা গাছেরা গ্রহণ করে বেঁচে থাকে আবার গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে যা মানুষ গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। ঠিক একইভাবে সমাজে একেক প্রাণী একেক প্রাণীর উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। একে অন্যের সাহায্য ছাড়া কেউই বেঁচে থাকতে পারে না। নানানভাবে সবাই সবার উপকার করে থাকে।
পুরুষ-মশা শুড় ঘষে বলল— কিন্তু আমরা মশারা তো কারও উপকার করি না। বরং ক্ষতিই করি সবসময়।
স্ত্রী-মশা মৃদু হেসে জবাব দিলো— ভুল কথা। বিষয়টা একটু গভীরভাবে দেখতে হবে। তবেই সঠিকটা জানতে পারবে। আমরা মানুষদের সচেতনতা বাড়াই। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে তারা। পানি দুষিত করে। আর ঐসব দুষিত পানিতেই আমাদের বংশবিস্তার হয়। আমরা বড় হয়ে স্ত্রী-মশারা মানুষের রক্ত খেয়ে ক্ষতি করি এবং তোমরা পুরুষ-মশারা মানুষের বেঁচে থাকার উৎস গাছদের পাতার রস খেয়ে ক্ষতি করো। এই ক্ষতির মাধ্যমেই মানুষের সচেতনতা বাড়ে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা এবং পানি দুষিত করতে অনুৎসাহিত হয় অনেকেই। এর ফলে পরিবেশ ও সমাজ মোটামুটি সুন্দর ও সুস্থ থাকে।
কথাগুলো শুনে পুরুষ-মশা বলল— আমরাও যে সমাজের উপকারী প্রাণী তা এতদিন জানাই ছিল না। মশা হিসেবে নিজেকে খুব ধন্য মনে হচ্ছে এখন। ধন্যবাদ বোন স্ত্রী মশা।
লেখকঃ জনি হোসেন কাব্য
ছড়াকার ও শিশু সাহিত্যিক।