• ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৩শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

এসো আলোর পথে —রিতা ফারিয়া রিচি

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত আগস্ট ১৭, ২০২২
এসো আলোর পথে —রিতা ফারিয়া রিচি

মেয়েটিকে প্রায়শই দেখা যায় পার্কের কিনারে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে। অদ্ভুত সুন্দর একটি ছাতা। হলুদের সাথে নীলের মিশ্রণ। ছাতার ওপর যখন রোদ এসে পড়ে চালতা ফুলের মতো চমৎকার মুখটা আরও বেশি মায়াবী হয়ে ওঠে।

মেয়েটির বুকের ভেতরে কি মেঘ জমে থাকে? অদৃশ্য বৃষ্টিপাতে সে কি জুবুথবু হয়ে যায় কখনো? নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে একাকী কি ভাবতে থাকে আনমনে?

অল্পবয়সে বেশ মুটিয়ে যাওয়া রীমা কতো কি ভেবে যায়! সে-ও প্রতিদিন পার্কে আসে। হাঁটাহাঁটি করার জন্য। পুরো অবয়ব হিজাবে ঢাকা থাকে। সংগত কারণেই কোন পুরুষের নজর তার ওপর পড়ে না।

রীমা চারপাশের চিকণ রাস্তা দিয়ে চক্কর মারে। পার্কটা বেশ বড়সড়। সাধারণত বয়স্কদের আধিক্য। কেউ রিলাক্স করার জন্য। কেউ হয়তোবা ফেলে আসা সোনালি অতীতের সোনাঝরা দিনগুলো রোমন্থন করেন। আকাশের দিকে উদাসীন দৃষ্টি মেলে। রিটায়ার্ড করা নারী-পুরুষের জন্য জায়গাটা আদর্শ বলেই ধরে নেয়া যায়।

হাঁটাহাঁটির মুহূর্তে বারবার তাকিয়েও মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছিলো না রীমা। সুন্দর একটা মেয়ে। চমৎকার মুখের গঠন। চুলগুলো কোঁকড়ানো না হলেও চেহারার সাথে মানানসই। পোশাক-আশাকে যথেষ্ট শালীনতা থাকলেও পর্দার প্রতি গুরুত্বহীন। দেখেই বুঝা যাচ্ছে। নামাজের প্রতি পুরোপুরি অবহেলা। কারণ, সময় সল্পতায় রীমা কয়েকদিন পার্কেই ঘাসের ওপর নামাজ আদায় করেছে। দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে, মেয়েটি একভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।

অনেকদিন ধরেই মেয়েটিকে ভালো লাগতে শুরু করেছে রীমার। বয়সে তার চাইতে দু’তিন বছরের ছোটই হবে। বুকের গহীনে গড়াই নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো ভালোবাসা উঠানামা করতে লাগলো। খুব ইচ্ছে করতো কাছে গিয়ে বসতে। কিছুক্ষণ গল্প করতে। অনেকবার কিছু একটা খোঁজার ভানকরে তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকেছে।
মেয়েটি আপন খেয়ালেই মগ্ন ছিলো।

একরাতে এশার সালাতে রীমা দোয়া করলো মেয়েটির জন্য। যেন তার ভালো দ্বীনি বোন হয়ে যায়। রীমার ভেতরেও কিছু অব্যক্ত বেদনা পাথর চেপে থাকা বেড়ে না ওঠা ঘাসের মতো মুখ থুবড়ে ছিল। একজন ভালো বন্ধুর জন্য হৃদয়টা শুষ্ক মরুভূমিরর মতো তৃষ্ণার্ত ছিলো দীর্ঘদিন যাবত।

পরেরদিন একই নিয়মে রীমা পার্কে গেলো। মেয়েটি আগের অবস্থানেই ছিল। ইচ্ছা করেই মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। মুখের নেকাবটা নামিয়ে হালকা হাসি ছড়িয়ে দিলো। মেয়েটি শতভাগ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। যেন এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিল। প্রথমে রীমাই শুরু করলো
– আপু আপনার নামটা জানতে পারি?
– আমার নাম জেরিন
কোনরকম জড়তা ছাড়াই উত্তর দিলো মেয়েটি। কথার আর্দ্রতায় মনে হলো আত্মীয়তার নিপূণ মসলিন কাপড়ে দু’জন মুড়ে আছে পূর্ব থেকেই। রীমার অভ্যন্তরে ভালোবাসার কম্পন তৈরী হয়ে আছড়ে পড়লো ভালোলাগার সৈকতে। যেনো প্রখর রোদ থেকে কাঙ্ক্ষিত গাছের ছায়ায় আশ্রয় পেলো। হিমেল বাতাসের স্পর্শে সস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারার আনন্দ তনু-মন হিল্লোলিত হলো।

দু’জন পাশের কাঠের বেঞ্চে গিয়ে বসলো। জেরিনের হাতের আঙ্গুলের মধ্যে রীমা হাতের আঙ্গুল ডুবিয়ে কথা আরম্ভ করলো। অল্পসময়ে অনেককিছু জেনে নিলো। সবগুলো প্রশ্নেরই মিষ্টি করে জবাব দিলো। খুলে বললো তার বেদনা জড়িত জীবনের দুঃখমাখা পঙতিগুলো।

দেড় বছর হয় জেরিন দর্শনে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। সহপাঠী একজনকে ভালোবাসতো। দু’জনের ভালোবাসার গভীরতা ছিল অসামান্য। জীবনটাকে এক সূত্রে গাঁথার পরিকল্পনা ছিল চূড়ান্ত। বাধ সাধলো দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে৷ যাদের অনাগ্রহের কাছে পরাজিত হলো পুষ্পিত চাওয়া। ভালোবাসার মানুষটি পাড়ি জমালো বিদেশে। জেরিন হয়ে গেলো একা। সেই থেকে নিঃসঙ্গতার জলে অবগাহন করে জীবনটাকে ভাসিয়ে দিলো অনিশ্চয়তার ভবিষ্যতে।

রীমা সব কথা শুনলো মন দিয়ে। বুঝানোর চেষ্টা করলো, ভালোবাসার কাছে জীবনের পরাজয় কোন শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত মানবীর জন্য শোভনীয় নয় বোন৷ পবিত্র কোরআন থেকে সূরা-বাক্বারার একটি আয়াতের উদ্বৃতি দিয়ে বললো, “নিশ্চয়ই আমি মানুষ এবং জ্বীন সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদাতের জন্য।”

ভালোবাসা জীবনের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ। যা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বরং ভালোবাসা নামক বিচ্ছুর সাথে সহাবস্থান করে জীবনটা নরকে পরিনত হওয়ার অসংখ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা যাবে।

ভালোবাসার জন্য জীবন নয়। জীবনের জন্য ভালোবাসা। যে ভালোবাসার একমাত্র দাবীদার আপনার-আমার জীবনের মালিক প্রাণের প্রিয়তম মহান রাব্বুল আলামিন। সেইসাথে মানবতার মুক্তির দূত, রহমাতুল্লিল আলামীন, পেয়ারা নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)।

এই পবিত্র ভালোবাসার চাইতে যদি হৃদয় সমুদ্রে কোন মানুষের ভালোবাসার ঢেউ প্রচণ্ডভাবে তরঙ্গায়িত হয় আমাদের জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য। আসুন আমরা ভালোবাসাকে পরিশীলিত করি। বুকের কন্দরে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল(সঃ) – এর ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়ে জীবনটাকে ধন্য করি।

আপুরে! দুনিয়াটা দুই দিনের। যার জন্য নিজেকে তামা করে দিচ্ছেন, আপনি মরে গেলে সেই প্রেমিক কি আপনার কবরে যাবে? মুনকার নকিরের সওয়ালের জওয়াব দিবে? কেউ আমাদের কবরে যাবে না বোন। আমাদেরকে একাই সবকিছুর মোকাবিলা করতে হবে।

কেনো নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছেন তুচ্ছ প্রেমের কাছে! প্রেম পর্যায়ক্রমে জীবনটাকে ধ্বংস করে দিবে। বেড়ে ওঠা সুরভিত গচ্ছিত পাপড়িগুলো একটা সময় নষ্ট করে পোকার জন্ম দিবে। জীবন কি এতোটাই তুচ্ছ? অবহেলিত? একবারও কি ভাববেন না রবের সাথে আপনার প্রতিশ্রুতির কথা? আপনি কি জানেন, রব আমাদেরকে কেবলমাত্র তাঁর গোলামীর জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। হীন প্রেমের কাছে বিক্রি হওয়ার জন্য নয়।

ইসলামের মৌলিক বিষয়ের ওপর আরও অনেক কথা বললো রীমা। সবগুলো কথাই আগ্রহ নিয়ে শুনে যাচ্ছে জেরিন। যেনো এই প্রথম ইসলামের আলোকিত ঝর্ণা ধারায় নিজেকে ভেজানোর আনন্দে শিহরিত হচ্ছিল। অবচেতন মনে ভাবতে লাগলো, হায় প্রেম! হায় বিরহ! এরজন্য নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি সর্বনাশের উত্তপ্ত বন্দরে? কি পেয়েছি এতোদিন অহেতুক ভাবনাকে প্রচ্ছয় দিয়ে?

রীমার দুই হাত চেপে ধরলো জেরিন। আপু গো আমাকে বাঁচান! ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে আমার হৃদপিণ্ড। একটা অর্থহীন কাজে নিজেকে বলী দিতে চলেছি। প্লীজ, আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই। চোখ মেলে দাঁড়াতে চাই হেদায়াতের পবিত্র জোছনায়।

তাকে বারবার সান্ত্বনা দিতে লাগলো রীমা। মানুষের পাপের তুলনায় আল্লাহর রহমতের ওজন অনেক বেশি। মানুষের সীমাহীন সীমালঙ্ঘনের পরেও পরম প্রভু তার জন্য সহাস্যে ক্ষমার দরজা খুলে রাখেন।

আপনি বেশি বেশি তওবা – ইসতেগফার করুন। আল্লাহ তওবাকারীকে খুব ভালোবাসেন। আজ থেকে পর্দা করুন। সঠিক নিয়মে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করুন। দেখবেন জীবনটা অনেক হালকা হয়ে যাবে।

রীমা যাওয়ার সময় জেরিনের হাতে ব্যাগ খুলে একটা বই ধরিয়ে দিলো, “এসো আলোর পথে।” বইটি আজ রাতেই পড়ার প্রতিশ্রুতি দিলো জেরিন। কাল আবার দেখা হওয়ার ওয়াদা করে উভয়ে হাঁটতে লাগলো আলাদা রাস্তায়।

আগেভাগেই রীমা অপেক্ষা করছিল। জেরিনকে দেখা মাত্রই সালাম দিলো,
–আসসালামু আলাইকুম
–ওয়ালাইকুম সালাম, আপু।
জেরিনের সুন্দর সাবলিল উত্তর। যেনো মেয়েটার সাথে এই প্রথম দেখা হলো। কালো বোরখার ওপর মুখটা হিজাবে ঢাকা। পোশাকে আচরণে নিটোল পবিত্রতার ছোঁয়া। রীমার চোখ ভিজে গেলো স্বর্গীয় আনন্দে। ইসলামের সংস্পর্শে একটা মানুষ কতো সহজে স্বল্পসময়ে পরিবর্তিত হতে পারে। মনে মনে মহান আল্লার শুকরিয়া আদায় করলো।

পাশে এসে বসলো জেরিন। অনেকটা গা ঘেঁষে। প্রথম প্রথম যার দিকে তাকাতেও কার্পণ্য করতো। এখন তার প্রতি আগ্রহ আছড়ে পড়তে লাগলো। রীমা প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,
–গতকালকের দেয়া বইটা পড়া হয়েছে?
–জ্বী আপু। রাতেই কয়েকবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
–মাশাআল্লাহ। আজ আরেকটা বই নিয়ে যাবেন। এরপর আপনাকে পড়তে হবে অর্থসহ কোরআন মাজিদ। প্রয়োজনীয় হাদিস এবং মাসলা-মাসায়েল জানতে হবে।
–অবশ্যই পড়বো আপু। আপনি আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। আপনার নজরে না পড়লে আমি অন্ধকারেই থেকে যেতাম।
–হেদায়াতের মালিক রাব্বুল আলামিন। আমি শুধু উছিলা মাত্র।

জেরিন বলতে লাগলো, আমি মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থ বোধ করছি আপু। ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করেছি। জোহরের নামাজও দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়েছি। আল্লার বন্দেগীতে কি যে শান্তি আপু! এই প্রথম অনুভব করলাম।

হঠাৎ করেই জেরিন জড়িয়ে ধরলো রীমাকে। কিছুক্ষণ এইভাবেই কেটে গেলো। রীমা বুকের ওপর হালকা চাপা দিয়ে ধরলো জেরিনের মাথাটা। একটা প্রশান্তি কাজ করতে লাগলো উভয়ের মধ্যে। মনে হলো আসমান থেকে নেমে আসা শান্তির শুভ্র বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো দুই মানবী। রীমা একটি ইসলামী সংগীত গাইতে আরম্ভ করলো। জেরিনও তার সাথে কণ্ঠ মিলালো–
“মোরা হতে চাই প্রিয়তম তোমার
মোদের কবুল করো হে পরোয়ার হে পরোয়ার!”

 

লেখকঃ রিতা ফারিয়া রিচি 

সাহিত্য সম্পাদকঃ দৈনিক দেশতথ্য বাংলা