• ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

আফগান বন্দীশালা থেকে ফিরে যে ব্রিটিশ সাংবাদিক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২, ২০২১
আফগান বন্দীশালা থেকে ফিরে যে ব্রিটিশ সাংবাদিক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন

বিবিএন ডেস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক ইভন রিডলির জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল ডারহামের স্ট্যানলি শহরে। চার্চ অব ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠায় অত্যন্ত নিজধর্ম পালনে ছিলেন সজাগ। অল্প বয়স থেকে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক। স্থানীয় পত্রিকা স্ট্যানলি নিউজ লেখালেখি করে সাংবাদিকতা শুরু। ডানপন্থী দল রিসপেক্ট পার্টির জাতীয় কাউন্সিলের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। লন্ডন কলেজ অব প্রিন্টিং-এ পড়াশোনা করেন। আফগানিস্তানে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে এসে বন্দী হন তিনি। এরপর মুক্তি পেয়ে অঙ্গীকার পূরণে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর বদলে যেতে শুরু করে রিডলির জীবন। 

প্রভাবশালী পত্রিকার কর্মতৎপরতা : এরপর একে একে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকাগুলোতে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। দ্য সানডে টাইমস, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট অন সানডে, দ্য অবজার্ভার, দ্য ডেইলি মিরর, দ্য নিউজ অব দি ওয়ার্ল্ডসহ অনেক পত্রিকায় কাজ করেন তিনি। এমনকি ওয়ালস অন সানডে পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালের মার্চে ইরাক হামলার বিরোধিতা করে রিডলি লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন।

আফগানিস্তান গিয়ে বন্দী হন যেভাবে : যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলার পর দ্য সানডে এক্সপ্রেস পত্রিকার চিফ রিপোর্টার হিসেবে আফগানিস্তানে ঢুকার চেষ্টা করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছিল। তাই রিডলি আফগানিস্তানে যাওয়ার ভিসা পাননি। কিন্তু বিবিসির সাংবাদিক জন কোডি ফিডলার-সিম্পসনের মতো ২৬ সেপ্টেম্বর বোরকা পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করেন। এরপর থেকেই বদলে যায় তাঁর জীবনপথ। দুই দিন আত্মগোপন থাকার পর একদিন গাধা থেকে নামতে গিয়ে তাঁর গোপন ক্যামরা তালেবান সদস্যের চোখে পড়ে। অতঃপর গুপ্তচর সন্দেহে তাকে আটক করা হয়। এরপর দীর্ঘ ১০দিন তাদের বন্দীশালায় থাকতে হয়।

মুক্তি লাভে দৌঁড়ঝাঁপ : সাংবাদিক রিডলির আটকের পর এক্সপ্রেস নিউজপেপারের প্রকাশক রিচার্ড ডেসমন্ড সরাসরি ইসলামাবাদে আফগান দূতাবাসে তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। সেই সময় ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হিলারি নিকোলাস সিনোট তাঁর মুক্তি নিয়ে কথা বলতে আফগান রাষ্ট্রদূত মোল্লা আবদুস সালাম জায়িফের সাক্ষাত করেন। অর্থ বা অন্য কোনো মুক্তিপণের দাবী না করে তারা রিডলির সাংবাদিক হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায়। এরপর তাকে মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়। ‍

বিবিসি নিউজ অনলাইনকে তৎকালীন সময়ের এক সাক্ষাতকারে রিডলি বলেছিলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই আমি তাদের কাছে ছিলাম খুবই ভয়ঙ্কর অপরাধী। আমার আগের ঘৃণ্য ধারণার কারণে তাদের দিকে থুথুও নিক্ষেপ করি। অনেক খারাপ ব্যবহার করি। খাবার খেতেও অস্বীকৃতি জানাই। মোটকথা মুক্তির আগ পর্যন্ত আমি ইসলামের প্রতি মোটেও আগ্রহী ছিলাম না।’

যেভাবে মুক্তি পান রিডলি : নিজের ইসলাম গ্রহণের গল্প বর্ণনা করেন তিনি বলেন, ‘তখন আমার আশংকা ছিল আমাকে যেকোনো সময়ই হত্যা করা হবে। কিন্তু ষষ্ঠদিন একজন বয়োবৃদ্ধ লোক আমার সাক্ষাতে আসেন। তিনি আমাকে লন্ডনে ফিরে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। আমি তার এর আহ্বান তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিলে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনার করব বলে তাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করি। এটা ছিল নিছক মুক্তির একটা পন্থা। এ বন্দীশালা থেকে মুক্তির জন্য আমি নানা পন্থা খুঁজছিলাম। ধোঁকা বা পন্থা যেভাবেই বলি আমার বুদ্ধি কাজে লাগে। মানবিক বিবেচনায় তালেবানের নেতা মোল্লা ওমরের নির্দেশনায় আমাকে ও সঙ্গে থাকা অনেককে তারা মুক্তি দেয়।’

ইসলাম নিয়ে দীর্ঘ পড়াশোনা : ‘কিন্তু মুক্তি পেয়ে আমি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করি। তাছাড়া তখন আমি মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেদক ছিলাম। এখানকার ধর্ম, জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে আমার আরো জানার প্রয়োজন ছিল। তাই আমি প্রথমে কোরআন পাঠ শিখি। মুক্তির পর ৩০ মাসে আমি ইসলাম নিয়ে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করি। আমার ধারণা ছিল, কোরআন পাঠের বিষয়গুলো অ্যাকাডেমিক আলোচনায় থাকবে। কিন্তু না, আমি নতুন আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ শুরু করি। আমি দেখতে পাই যে, পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে নারী ও পুরুষকে শিক্ষা, সম্পদ ও আচার-ব্যবহার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা। তবে অনেক মুসলিম ইসলামের বিধি অনুসরণ করে না।’

কারামুক্তির ৩০ মাস পড়াশোনার পর রিডলি ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হন। অতঃপর ২০০৩ সালের আগস্টে কালেমা শাহাদাহ পাঠ করে মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন শুরু করেন।

মুসলিম অধিকার নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা : ইসলাম ইসলাম গ্রহণের পর রিডলি এক্সপ্রেস পত্রিকা থেকে অব্যাহতি নেন। ইসলামের বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বক্তব্য ও আলোচনা শুরু করেন। দোহা থেকে সম্প্রচারিত আল জাজিরা ইংরেজি ভার্সন শুরু হলে তিনি সিনিয়র সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি ইসলাম, মুমসলিম সমাজ ও নারী নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় লেখালেখি শুরু করেন। ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন ইসলামী টিভি ও রেডিওতে কথা বলেন। ফিলিস্তিন, আফগান, ইরাক, বসনিয়া, কাশ্মিরসহ বিশ্বের নিপীড়িত মুসলিমদের অধিকার নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। এছাড়াও পশ্চিমাবিশ্বের মুসলিম নারীদের হিজাব পরার অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করেন। মুসলিম অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হওয়ায় রিডলিকে অনেক বার জীবননাশের হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইসলামের প্রতি তাঁর মনোভাব পরিবর্তন হওয়ায় অনেকে তাকে স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে মনে করেন যারা অপহৃত হয়েও অপহরণকারীদের প্রতি আনুগত্য, আবেগ ও গভীর টান অনুভব করা।’

ইসলাম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা : তালেবানের বন্দশালায় কাটানো মুহূর্তগুলো নিয়ে তিনি রচনা করেন অনবদ্য গ্রন্থ ‘ইন দ্য হ্যান্ড অব তালেবান : হার এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্টোরি’। দ্য সানডে এক্সপ্রেস-এর প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তা রচনা করেন। একই সময় তাঁর ‘দ্য টিকেট টু প্যারাডাইজ’ নামে আরেকটি বই প্রকাশিত হয়।

এভলি রিডলি বলেন, ‘আল্লাহ নারীকে শিশু জন্মদানের বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। ইসলাম নারীর এ বৈশিষ্ট্যকে অত্যন্ত উঁচু সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। তাই হাদিসে জান্নাতকে মায়ের পদতলে বলা হয়েছে। তাছাড়া মায়ের অধিকার বাবার চেয়ে তিন গুণ বেশি বলা হয়েছে। ইসলামে মানুষের সম্মানের মূলভিত্তি হলো তাকওয়া তথা খোদাভীতি। সৌন্দর্য, সম্পদ, শক্তিমত্তা বা সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে নয়। একজন মুসলিম হিসেবে আমারও শিক্ষার অধিকার আছে। শিক্ষা অর্জনে বের হওয়ার অধিকার আছে।’

‘অনেক রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক নারীর প্রতি ইসলাম কেমন অবিচার করেছে তা লিখতে চান। অথচ তারা হিজাব পরা নারীদের সঙ্গে কথা বলতে ভুলে যান। মূলত ইসলামী শরিয়তে মুসলিম নারীরা কেমন সম্মান ও নিরাপত্তায় থাকেন তাদের এ সম্পর্কে কোনো ভাবনা নেই। ১৪ শ বছর আগ থেকে ইসলাম নারীদের এ সম্মাননা দিয়ে আসছে।

সূত্র : আর্থার এল কার্টার জার্নালিজম ইনস্টিটিউট, রিলিজিয়ান ইনফো, বিবিসি, উইকিপিডিয়া ও ইসলামিক স্টোরি।