• ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস সস্ত্রীক সফরে এসে জয় করে নিলেন বাংলা টাউন ও বাংলাদেশিদের হৃদয়

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩
ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস সস্ত্রীক সফরে এসে জয় করে নিলেন বাংলা টাউন ও বাংলাদেশিদের হৃদয়

 

মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার,বিশেষ প্রতিবেদক:রাজা এলেন শহরে, মিশলেন জনতার সাথে, দেখলেন এই শহরের ইতিহাস—ঐতিহ্যের স্মারক প্রতিষ্ঠান, শামিল হলেন এ শহরের কিছু সংস্কৃতির উদযাপনে, গেলেন তিনটি প্রধান ধর্মের পবিত্র উপাসনালয়ে; অত:পর রাজা ফিরে গেলেন তাঁর প্রাসাদ প্রাঙ্গণে, আজ সেখানে স্থান পেয়েছে এই শহরের বাসিন্দাদের সংগ্রামী অতীতের কথা আর বর্তমান সাফল্যের উজ্জ্বল কীর্তিগাথা।


ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ও কুইন কনসর্ট ক্যামিলা বুধবার ৮ ফেব্রুয়ারি এসেছিলেন ব্রিটেনে বাঙালি কমিউনিটির প্রাণকেন্দ্র বাংলা টাউনে। মাল্টিকালচারাল ব্রিটেনের প্রতি রাজা চার্লসের আন্তরিক অঙ্গীকারের কথা সকলের জানা। বুধবার বাংলা টাউন সফরের মধ্য দিয়ে রাজার সেই অঙ্গীকার আবারও প্রতিফলিত হলো। এর মধ্য দিয়ে রাজা ও তাঁর সহধর্মিণী মন জয় করে নিয়েছেন গোটা বাংলা টাউনের।


সফর সূচি অনুযায়ি ঠিক বেলা ১১টায় তাঁরা এসে পৌঁছুলেন ব্রিক লেনের কাছে শহীদ আলতাব আলী পার্কের প্রধান ফটকে। সেখানে তাঁদের স্বাগত জানালেন গ্রেট ব্রিটেনের লর্ড লেফটেন্যান্ট স্যার কেনেথ ওলিসা ওবিই। সাথে ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের বারার ডেপুটি লেফটেন্যান্ট ড. আব্দুল বারী এমবিই।


এর পর রাজকীয় অতিথিদের স্বাগত জানান টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার শাফি আহমদ এবং নির্বাহি মেয়রের প্রতিনিধি ডেপুটি মেয়র মাইয়ুম তালুকদার।
তাঁর পরপরই রাজন্যবর্গকে সমাবেশস্থলে স্বাগত জানালেন রাজা ও কুইন কনসার্টের বাংলা টাউন পরিদর্শন কর্মসূচির আয়োজক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ বাংলাদেশী পাওয়ার এন্ড ইন্সপিরেশন —বিবিপিআইয়ের ফাউন্ডার ট্রাস্টি আয়েশা কোরেশী এমবিই জেপি ও কাউন্সিলার আবদাল উল্লাহ।


রাজা ও কুইন কনসর্ট আলতাব আলী পার্কে প্রবেশের পরপরই আমন্ত্রিত অতিথিদের সারির দিকে এগিয়ে যান এবং উপস্থিত বিপুল অভ্যাগতের সাথে করমর্দন করেন।
এরপর আয়েশা কোরেশী ও আবদাল উল্লাহ রাজকীয় অতিথিদের নিয়ে আসেন শহীদ মিনারের মূল চত্বরে। এ সময় মালবেরী স্কুল এবং লন্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমীর একদল শিক্ষার্থি ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা নেড়ে তাঁদের স্বাগত জানায়।


এখানে রাজা ও কুইন কনসর্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, ৭০—এর দশকে লন্ডনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন—সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া সে সময়ের যুব কর্মীদের সাথে, তাঁরা পরিচিত হন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং মিডিয়া ও সংস্কৃতি জগতের পুরোধা ব্যক্তিবর্গের সাথেও।

রাজা ও কুইন কনসর্টের সাথে এখানে যাঁদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হেলাল উদ্দিন আব্বাস, রাজন উদ্দিন জালাল ও আনসার আহমদ উল্লাহ; মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, উর্মি মাজহার, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো: এমদাদুল হক চৌধুরী, সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার।

এই পরিচিতি পর্বে উর্মি মাজহার রাজকীয় অতিথিদের কাছে সংক্ষেপে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনারের তাৎপর্য বর্ণনা করেন। নবাব উদ্দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসি বাঙালিদের অবদান, এই মুক্তিযুদ্ধ সফলে ব্রিটেনের জনগণ ও সরকারের সর্বাত্মক সমর্থন এবং বর্তমানে কারী ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে ব্রিটেনের জাতীয় অর্থনীতিতে ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের অবদান রাখার কথা তুলে ধরেন।


এই সংক্ষিপ্ত পর্বের পর রাজা চার্লস বর্ণবাদীদের হামলায় আলতাব আলীর মৃত্যু বরণের ৪৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে শহীদ মিনারের সম্মুখবর্তী একটি অংশে এলম ট্রি—র একটি চারা রোপণ করেন। এ সময় প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সোহিনী আলম পরিবেশন করেন বিবিপিআইয়ের থিম সং: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।


এর পর রাজা ও কুইন কনসর্ট গাড়িযোগে অসবোর্ন স্ট্রিট হয়ে যান ব্রিক লেইনে বাংলা টাউন গেইটে। তাঁদের সাথে ছিলেন আয়েশা কোরেশী ও আবদাল উল্লাহ। সেখানে রাজন্যবর্গকে স্বাগত জানান ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম। এখানে আরও উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলা টাউন ফটকের কাছে রাস্তার পার্শ্ববর্তী ভবনে ‘মাটির টান’ শীর্ষক দেয়ালচিত্রের অঙ্কন শিল্পী মোহাম্মদ আলী এমবিই এবং বিশিষ্ট ব্রিটিশ বাংলাদেশি ব্যবসায়ি, উদ্যোক্তা ও চ্যারিটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।


ব্রিক লেইন সড়কের দু‘পাশে ফুটপাতে তখন তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না। হাজার হাজার মানুষ রাজদর্শন ও রাজকীয় অতিথিদের সে সময় হর্ষোৎফুল্ল ধ্বনি সহযোগে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন হাত নেড়ে, তাঁদের সাথে হাত মিলিয়ে ও তাঁদের পুষ্পস্তবক উপহার দিয়ে। এ সময় স্থানীয় ক্রাইস্টচার্চ স্কুলের শিশু শিক্ষার্থিরা ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা নেড়ে রাজকীয় অতিথিদের শুভেচ্ছা জানায়।
এরপর তাঁরা হেঁটে এগিয়ে যান ঐতিহ্যবাহি গ্রাম বাংলা রেস্টুরেন্টের দিকে। তাঁদের সামনে তখন এগিয়ে চলছিলো ঢোলকবাদ্যের সাথে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সোনিয়া সুলতানা ও তাঁর দলের বাংলার লোকজ নৃত্যের একটি চলমান পরিবেশনা।
গ্রাম বাংলা রেস্টেুরেন্টে রাজা ও কুইন কনসর্ট পরিচিতি হন বিবিপিআই জামদানী নেটওয়ার্কের সাথে সম্পৃক্ত ১৭ জন ব্রিটিশ বাঙালি নারী উদ্যোক্তার সাথে। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত মেক আপ আর্টিস্ট রুবি হ্যামার এমবিই, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্লাইমেট গ্রুপের হেড অব ট্রান্সপারেন্সি এন্ড পাথওয়েজ জেবি রহমান, ক্রাউন এন্ড ফ্যামিলি কোর্টের সার্কিট জাজ স্বপ্নারা খাতুন, স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও ব্রডকাস্টার রেশমিন চৌধুরী, সালমা গুল বাহার, হুসনা মর্তুজা, শামসুন্নেহার, আলিমা কোরেশী, কানিজ আলী, নিলুপা উদ্দিন, প্রপা রেজওয়ানা আনওয়ার প্রমুখ।
প্রপা রেজওয়ানা আনওয়ার এখানে কুইন কনসর্টকে বিবিপিআই জামদানী নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত জামদানী শাড়ি উপহার দেন। ক্রিম ব্যাকগ্রাউন্ডে এই শাড়ি বোনা হয়েছে লাল ও সবুজ রঙে।
নিলুপা উদ্দিন তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বাই ‘হাফওয়ে‘ এর একটি কপি এখানে রাজা চার্লসকে উপহার দিয়েছেন।
গ্রাম বাংলা থেকে রাজকীয় অতিথিরা হেঁটে যান ঐতিহাসিক ব্রিক লেইন জামে মসজিদে। রাস্তার দু‘পাশে তখনও হাজারো মানুষ দাঁড়িয়ে রাজদর্শনের অপেক্ষায়।
রাজা ও কুইন কনসর্টকে মসজিদে স্বাগত জানান মসজিদের ট্রাস্টিবৃন্দ। তাঁরা মহামান্য অতিথিদের কাছে মসজিদ ভবনের তিনশ‘ বছরের পুরনো ইতিহাসের কথা তুলে ধরেন। আন্ত:ধর্ম সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও কমিউনিটির জন্যে এই মসজিদের সেবাধর্মী সার্ভিসের কথাও তাঁরা রাজকীয় অতিথিদের অবহিত করেন। এখানে একজন খ্রীস্টান ও একজন ইহুদী ধর্মনেতা উপস্থিত ছিলেন। মসজিদ পরিদর্শনের সময় মুসলিম প্রথার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কুইন কনসর্ট মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে নেন।
এবার বিদায়ের পালা।
ঘড়ির হিসেবে রাজ্যবর্গের এক ঘন্টার সফর তখন এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে। রাজার কোন তাড়া ছিলো না। রাজা ও তাঁর সহধর্মিণী ব্রিটেনে বাঙালির পদার্পণ থেকে শুরু করে সংগ্রামী সাধনার মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছুবার কাহিনী জানতে ও দেখতে ছিলেন গভীর আগ্রহী।
মাটির মানুষ রাজা ও রাণী তাঁদের সফরের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ—বাংলাদেশীদের মন জয় করে মধ্য দুপুরে ফিরেছেন বাংলা টাউন থেকে।