• ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

উপনিবেশ মুক্তির লড়াই ও সেই আজাদি কথা

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত আগস্ট ১৪, ২০২২
উপনিবেশ মুক্তির লড়াই ও সেই আজাদি কথা

ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনে বাংলা ও বাঙালির একটা গ্লানি ছিল বৈকি। ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রহসনমূলক যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমেই মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রুলের পথ সূচীত হয়। ফলে বাঙালির মনে এই গ্লানি মোচনের দায় ছিল। জগত শেঠ, মীর জাফর, রাজ বল্লভ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ সূচীত সেই গ্লানি মুছতেই বুধোয় (বোধয়) আজাদির আদি সংগ্রাম-পর্বে ফকির মজনু শাহ’র নেতৃত্বে প্রথমত ফকির ও আলেম আর পরে ফকির-সন্যাসিদের যুগপৎ বিদ্রোহ, হাজি শরিয়ত উল্লাহ-তিতুমীরদের ফরায়েজী ও নীলকর বিরোধী বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলার মানুষ তার প্রায়শ্চিত্ত শুরু করছিল।

অবশ্য এই সমসাময়িক কালে হিন্দুস্তানেও মুসলিম আলেমরা, খাস কইরা শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী, মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ, সৈয়দ আহমদ বেরলভি, হযরত শাহ ইসমাঈল, মাওলানা আব্দুল হাই, মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানতুবী ও মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী লড়াই জারি রাখেন।

আবার আজাদির সংগ্রামের দ্বিতীয় তথা আধুনিক-পর্বে বিকশিত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও তুলনামূলক অল্পবিকশিত/বিকাশমান বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তই একটা বড় ভূমিকা রাখলো। ফলে বাংলাতেই হিন্দু জাতিয়তাবাদী (যা পোশাকিভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিসাবেই প্রচারিত) চিন্তন ও আন্দোলনের সূচনা হয়। বাংলাতেই তৈরি হয় অনুশীলন ও যুগান্তর এর মতো কালীভক্ত গুপ্ত বিপ্লববাদী সশস্ত্র সংস্থাসমূহ। যার ধারাবাহিকতায় পরে বাংলাতেই, খাস কইরা পূর্ববাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। এমুনকি অনুশীলন সমিতির পূর্বে ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী গঠন করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারত সভা। পরে যার লক্ষ্য ও আদর্শের মোমেনটামেই ১৮৮৫ সালে গঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। অর্থাৎ কংগ্রেস গঠনেও বাংলার মগজ ও মনন একটা বড় ভূমিকা রাখছিল। ইংরেজদের লগে দেনদরবার কইরা নিজেদের কিছু অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই (ছদ্ম) ভারতীয় জাতিয়তাবাদি (অন্তরভূমে যার হিন্দু জাতিয়তাবাদি প্রবণতা ক্রিয়াশীল ছিল) দলটার প্রথম অ-ইংরেজ সভাপতিও হন সেই বাঙালি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।

এছাড়া ১৯২৩ সালে মহাত্মা গান্ধীর নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কইরা কংগ্রেস থিকা বের হইয়া বাংলাসহ সর্বভারতীয় কংগ্রেসি (জাতিয়তাবাদি) মুসলিমদের জোর সমর্থনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘স্বরাজ পার্টি’ গঠন করেন। এর মাঝেই ১৯১৫ সালে হিন্দু জাতিয়তাবাদের প্রকাশ্য ঝাণ্ডা হাতে হিন্দু মহাসভা গঠনের পর এর বিকাশে বাংলারই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রাখেন বড় ভূমিকা। পরে তিনিই প্রথম হিন্দু জাতিয়তাবাদি রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসংঘ গঠন করেন। আরো পরে এই হিন্দু মহাসভা ও জনসংঘের ধারাতেই হিন্দুত্ববাদি রাজনৈতিক চিন্তা দর্শন কর্ম ও কর্মসূচির ক্যাম্পহাউজ আরএসএস এর সৃষ্টি হয়।

আবার গান্ধীজীর অহিংসা নীতির উপর আস্থা হারায়া লীগ ও কংগ্রেসের বাইরে ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে আরেক বাঙালি হিন্দু আইকন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে (অবশ্য প্রধান নেতার বাইরে এই ফৌজে হিন্দুস্তানিদের ব্যপক প্রাধন্য ছিল। যেমুন এই ফৌজের শীর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন মেজর জেনারেল মুহাম্মদ জামান কিয়ানি, মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান, কর্নেল শওকত আলী, কর্নেল প্রেম সায়গল, রশিদ আলি ও আবিদ হাসান সাফরানি প্রমুখ) গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। আর এই ফৌজই আজাদির জন্য সরাসরি ইংরেজ বিরোধী যুদ্ধ শুরু করে। এতো গেলো একপাশের কথা।

আরেকপাশের পরিস্থিতিও অনেকটা একইরকম। তয় এইখানে আধুনিক-পর্বে বাংলার বাইরে তথা হিন্দুস্তানের স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় আন্দোলনের একটা বড় ভূমিকা ছিল। তারপরও এতে বাংলার মুসলিমদের ছিল বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর এই ভূমিকার ভ্যানগার্ড ছিলেন হিন্দুস্তানের আলীগড়ে স্যার সৈয়দ আহমদ খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতীফ। ১৮৬৩ সালে তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি। মূলত আলীগড় আন্দোলন ও মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির ধারাবাহিকতায় ১৯০৬ সালে ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক সংগ্রামের আধুনিক প্লাটফর্ম হিসাবে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। আর তা বাংলার আরেক নবাব স্যার সলিমুল্লাহ এর উদ্যোগে তৎকালীন পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী এই ঢাকাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম লীগ একইসংগে কংগ্রেসের মতো ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ও ভারতীয় মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র হোমল্যান্ড কায়েমের লড়াই চালায়। বলতে দ্বিধা নাই লীগে কায়দে আজম জিন্নাসহ শীর্ষ পর্যায়ে হিন্দুস্তানিদের ব্যপক প্রভাব সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখছে মূলত বাঙালি মুসলিমদের রাজপথের সংগ্রাম ও ভোটের লড়াইয়েই।

এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ভারতীয় মুসলিমদের মুক্তির সনদ ‘লাহোর প্রস্তাব’ উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে এরই ধারাবাহিকতায় লীগের দিল্লী অধিবেশনে আরেক মহান বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ পেশ করেন।

সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ ব্যপক বিজয় লাভ করে। আর ৪৬ এর ডাইরেক্ট একশন ডে বা প্রত্যক্ষ্য সংগ্রাম দিবস-এ মহা কলকাতা দাঙ্গায় বাঙালি মুসলিমদের খুনেই কলকাতার রাজপথে যেন পাকিস্তানের চূড়ান্ত ভাগ্যলিপি লেখা হয়।

‘হাতো মে বিড়ি মু মে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ এর সেই সংগ্রাম-পর্বে সোহরাওয়ার্দীর পাশে আবুল হাশিম, আকরাম খাঁ প্রমুখ যেমুন ছিলেন তেমনি সেইসময়কার ছত্রনেতা শেখ মুজিবসহ হাজার হাজার বাঙালি মুসলিম তরুণ ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে জানবাজ লড়াইয়ে সামিল ছিলেন। সেই লড়াইয়ের পথেই ৪৬ এর নির্বাচন আর ডাইরেক্ট একশন ডে-র আত্মত্যাগ ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসন অবসানের পাশাপাশি ভারত বিভক্তির মাধ্যমে স্বাধীন পাকিস্তানের উন্মেষ ঘটায়।

উপনিবেশিক শোষণ ও অনেকটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিভ্রাতাসুলভতার যূপকাষ্ঠে নিপতিত ভারতের উপেক্ষিত, নিপীড়িত, আধাবিকশিত/বিকাশমান মুসলিম মধ্যবিত্ত ও অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন অনিরাপদ মুসলিম পুঁজি নিজের জন্য নিরাপদ এক মাটি পায়। পায় স্বপ্নের হোমল্যান্ড। আজ সেইদিনের হিরক জয়ন্তীতে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি উপনিবেশ বিরোধী গৌরবময় লড়াইয়ের সকল শহীদ ও বীর যোদ্ধাদের।

[বয়ান চলতি কথনরীতিতে লেখা]

লেখকঃ জগলুলহায়দার বিশিষ্ট ছড়াকার

ছবিঃ আন্তনেট।