মোঃ ফিরুজুল ইসলাম চৌধুরী, শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) থেকে :হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে ধীরে-ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ এবং হারিয়ে যাচ্ছে ‘গাছি’ নামক শিল্পীরা। সেইসাথে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে শীতকালীন ঐতিহ্য খেজুরের রস। পল্লীবাংলার পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কালজয়ী ‘মামার বাড়ি’ কবিতার পংক্তি ‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ,। মধুমাস জৈষ্ঠ্যের মতো মাঘ মাসেও রসনা তৃপ্তির জন্য মধু পাওয়া যায়। তা হচ্ছে মধুবৃক্ষের রস, অর্থাৎ খেজুরের রস। এ অঞ্চলে একটি গ্রাম্য প্রবাদবাক্য আছে ‘মাটির হাড়ি কাঠের গাই, গলা কেটে দুধ খাই’। গাছসহ খেজুরের রস বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে কালান্তরে চলে যাবে এসব প্রবাদ বাক্যও।
শায়েস্তাগঞ্জসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ জনপদ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ। ঐতিহ্যগতভাবে শীতের ভোরে একগ্লাস খেজুরের রস পান করতে ইচ্ছা জাগে রসনা বিলাসীদের। গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যের বাহক এই মধুবৃক্ষ তুলনামূলকভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। গ্রামে মাঠের ধারে মেঠোপথের কিনারে অথবা ঘরের কোণে খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে থাকতে এখন আর চোখে পড়েনা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই খেজুরগাছ আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। কারণ যে হারে খেজুরগাছ নিধন করা হচ্ছে, সে তুলনায় রোপণ করা হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে দু’একটি খেজুরগাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। শীত মৌসুমের সকালে খেজুরের তাজা রস ও রসে ডুবানো পিঠার স্বাদ আর মৌ-মৌ গন্ধ যে কতটা মধুর তা বলে শেষ করা যাবেনা।
উপজেলার খোয়াই নদী সংলগ্ন চরহামুয়া গ্রামের আব্দুল আলী জানান, এলাকায় গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এক সময় এই এলাকায় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল, অনেক রসও পাওয়া যেতো। এখন খেজুর গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে পেশাদার ‘গাছি’ শিল্পীরা অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় তাদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। শীত মৌসুমের শুরুতে গ্রামাঞ্চলে খেজুর গাছের রস আহরণের কাজে পেশাদার ‘গাছিদের’ আর দেখা যায়না।
মররা গ্রামের ‘গাছি’ বাবুল মিয়া জানান, খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় তাদের চাহিদাও কমে গেছে। আগে এই কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চালাতে পারতেন এবং তাতে সংসার চালিয়ে কিছু সঞ্চয়ও করা যেতো। এখন গ্রামে যে কয়েকটা খেজুর গাছ আছে, তা বেশী বয়সের হওয়ায় তাতে তেমন রস পাওয়া যাচ্ছে না। আগে এক হাড়ি খেজুর রস বিক্রি হতো ১০০ টাকায়, এখন খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় সে রসের দাম বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা।
দাউদনগর বাজারের গুড় ব্যবসায়ী মোঃ আলীম বলেন, এখন শীত মৌসুমের ভোরে এক গ্লাস তাজা খেজুরের রস পাওয়া না গেলেও খেজুররসে তৈরি পাটালী গুড়, ঝোলা গুড়, মরিচা গুড় ইত্যাদি এখনও পাওয়া যাচ্ছে। দেশের যশোর, ঝিনাইদহ এবং ফরিদপুর অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ খেজুর গাছ দেখা যায়। ওইসব এলাকায় বণিজ্যিকভাবে খেজুরের রস থেকে বিভিন্ন প্রকারের গুড় উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এই উৎপাদিত গুড় মৌসুমে সারাদেশে প্রেরণ করা হয়। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুররস এবং রসে তৈরি নানান ধরনের সুস্বাদু ও সুগন্ধি গুড়কে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। এর অংশ হিসেবে বিদ্যমান খেজুরগাছের সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি নতুন করে খেজুরগাছ রোপণ করা জরুরী বলে মনে করেন এলাকার পরিবেশ সচেতন লোকজন।
এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুকান্ত ধর বলেন, খেজুর গাছ এবং এর রস ঐতিহ্যগতভাবে বাংলার সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। পুষ্টিগুণ এবং মিষ্টতায় এর জুড়ি মেলা ভার। খেজুরের রস থেকে তৈরী গুড় বাংলার পিঠা উৎসবের মূল অনুসঙ্গ। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পতিত জমিতে এবং রাস্তার দু’পাশে খেজুর গাছ লাগানো যেতে পারে। এতে পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নান্দনিকতার ছন্দ ছড়াবে। বর্তমানে অনেকেই বাণিজ্যিক ভাবে সৌদিআরবের খেজুরের বাগান করছেন। কিন্তু তার পরিমাণ অনেক কম। সরকারি উদ্যোগে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় দেশি খেজুর সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে কৃষি বিভাগ এ বিষয়ে প্রচারণা করছে।