সালেহা পারভীন: ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ; সুদীর্ঘ ১৮ বছর আমি সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম আমার প্রথম কর্মস্থল সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলাধীন জগন্নাথপুর পৌর এলাকার ঐতিহ্যবাহী হবিবপুর গ্রামের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২ নং আব্দুল তাহিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ে আমি নিজে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছি এবং সেখানেই প্রথম শিক্ষকতা করেছি। এজন্য ইহা আমার প্রাণপ্রিয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ঐহিত্যবাহী হবিবপুর গ্রামের শাহপুরের বাসিন্দা আমাদের গোষ্ঠীর শিকড় পুরুষ মরহুম আব্দুল তাহিদ সাহেবের বাড়িকে সবাই “রাজার বাড়ি” বলতো। ছোটবেলা আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ঐ বাড়িকে কেন রাজার বাড়ি বলা হয়? আম্মা বলেছিলেন, তিনি তৎকালীন সময়ে আমাদের গ্রামের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়ায় সবাই উনাকে “রাজা” বলে ডাকতো। সেই রাজার ধন দৌলত এখন কতটুকু আছে, সেটা জানার মোটেও কোনো ইচ্ছা আমার নেই, তবে মরহুম জনাব আব্দুল তাহিদ সাহেবকে নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা আমার শখ ছিল এবং ইহা আমার দায়িত্ব বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ তিনি সেই বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেই হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সহজেই সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছে। আমি তো সেখানে শুধু শিক্ষা লাভ করিনি, সেখানে শিক্ষা দান করেছি ১৮ বছর। ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমাদের গ্রামেরই ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ ৩ নং হবিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছি, যে বিদ্যালয়ে আমার মা বাবা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি মহৎ কাজ। চলুন জানা যাক, পারিবারিক সূত্রে পাওয়া জনাব মরহুম আব্দুল তাহিদ সাহেবের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
জগন্নাথপুর উপজেলাধীন ২ নং আব্দুল তাহিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত
🇧🇩🇧🇩🇧🇩🇧🇩 প্রতিষ্ঠাতা পরিচিতি 🇧🇩🇧🇩🇧🇩🇧🇩
জনাব মরহুম আব্দুল তাহিদ সাহেব ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিজ অর্থায়নে প্রায় ২১ শতাংশ ভূমির উপর একটি আধাপাকা ভবন নির্মাণ করে স্বনামে ‘আব্দুল তাহিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন, যা ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়করণ হওয়ায় ‘আব্দুল তাহিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে নথিভুক্ত হয়। স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানটি এক সময় একটি মডেল স্কুলের স্বীকৃতি পেয়েছিল বলে আজো ইহা জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদে ও উপজেলা নির্বাচন অফিসে ‘এ. টি. মডেল প্রাইমারি স্কুল’ নামে পরিচিত। এলাকার শিক্ষা বিস্তারে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে মরহুম জনাব আব্দুল তাহিদ সাহেবের সুযোগ্য সহধর্মিণী জনাব দিলারা খানম অত্র বিদ্যালয়ের স্কুল ম্যানেজিং কমিটির ভূমিদাতার প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জনাব আব্দুল তাহিদ, পিতা: আব্দুর রহমান, মাতা: জুবেদা খাতুন, গ্রাম: হবিবপুর শাহপুর, ডাকঘর ও উপজেলা: জগন্নাথপুর, জেলা: সুনামগঞ্জ, ১৯০৭ খ্রিস্টব্দের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
জনাব আব্দুল তাহিদের জীবন খুবই বৈচিত্র্যময় ছিল। তিনি ছোটবেলা থেকে একজন স্বভাবকবি ছিলেন। তিনি মুখে মুখে গান বানাতে পারতেন। ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচন্ড বাসনা থেকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভূমি ত্যাগ করে আমেরিকা যাত্রা করেন এবং এক নাগাড়ে সুদীর্ঘ ৩২ বছর সেখানে অবস্থানের পর প্রচুর অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়ে ‘রাজার বেশে’ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এলাকার অনেকে আজো তাঁর বাড়িটিকে ‘রাজার বাড়ি’ বলে পরিচয় দেন। কারণ তিনি দেশে ফেরার পর রাজার মতো গরীব মানুষের মাঝে অর্থ বিলিয়ে দিতেন, অনেক মানুষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে সহায়তা করেন এবং শিক্ষাবিস্তারে ও জনকল্যাণে প্রচুর অর্থ সম্পদ ব্যয় করেন। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য দানশীল ব্যক্তি ছিলেন।
প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী মেধাবী পুরুষ জনাব আব্দুল তাহিদ সাহেব আমেরিকা থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে জড়িত ছিলেন। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান লীগ অব অ্যামেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ, এশিয়া লীগ অব অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট, ইন্ডিয়ান লীগ অব অ্যামেরিকার সদস্য হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব আব্দুল তাহিদ মার্কিন মুল্লুকে পড়ে থাকলেও তাঁর মনটা পড়ে থাকতো মাতৃভূমির নিজ পল্লীতে। ব্যস্ততম জীবনে অবসর সময় পেলে তিনি মনের শখে নিষ্ঠার সাথে গান লিখতেন। দেশে আসার সময় তিনি কিছু পাণ্ডুলিপি সাথে নিয়ে আসেন এবং দেশেও আরো কিছু সংগীত রচনা করেন। এসব থেকে বাছাইকৃত কিছু গান নিয়ে “তাহিদ গীতি” নামে একটি পুস্তিকা বের হয় তাঁর শেষ জীবদ্দশায়। স্বনামধন্য কবি ও সাহিত্যিক মাস্টার জনাব আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী কর্তৃক ১৯৭৯ সালে গঠিত ‘হবিবপুর পল্লী সাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা পরিষদ’ কর্তৃক ‘তাহিদ গীতি’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালের জুন মাসে এবং এই বইটি সম্পাদনা করেন শ্রদ্ধেয় কবি ও সাহিত্যিক জনাব মাস্টার আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী সাহেব।
অত্যন্ত সদালাপী, সদানন্দ, মিশুক, মহৎ এবং প্রতিভাবান পুরুষ জনাব আব্দুল তাহিদ সাহেব স্বদেশে ফিরে ঐতিহ্যবাহী হবিবপুর গ্রামের কিশোরপুরের মরহুম জনাব রাহাত উল্লাহ সাহেবের কন্যা জনাব দিলারা খানমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি সহধর্মিণী ও পাঁচ সন্তান রেখে যান। তাঁর তিন পুত্র জনাব আব্দুল আউয়াল, জনাব আবু হাসনাত, জনাব নাঈম শরীফ স্বপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করছেন। তাঁর দুই কন্যার মধ্যে মিসেস দিলবাহার হক আমেরিকায় এবং মিসেস দিলমায়া হোসেন ইংল্যান্ডে স্বপরিবারে বসবাস করছেন। জনাব মরহুম আব্দুল তাহিদ সাহেবের প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী জনাব দিলারা খানম যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাজ্যে ছেলেমেয়ে নাতিনাতনির কাছে মাঝে মাঝে বেড়াতে যান। তবে তিনি বার বার ফিরে আসেন তাঁর স্বামীর ভিটায়, যেখানে শুয়ে আছেন এক স্বভাবকবি, এক হৃদয়বান পুরুষ, এক সমাজসেবক জনাব মরহুম আব্দুল তাহিদ সাহেব। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি, তাঁর সহধর্মিণীর সুস্বাস্থ্য কামনা করি এবং তাঁর সন্তানদের সার্বিক কল্যাণ কামনা করি।
আমার অনেক দিনের শখ ছিল আমার প্রথম কর্মস্থলের প্রতিষ্ঠাতা জনাব আব্দুল তাহিদ সাহেবকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখি। শখটি পূরণ হলো তাঁর মেয়ে মিসেস দিলবাহার আপার সাথে দেখা হওয়ার পর। তিনি আমাকে কিছু তথ্য ও ‘তাহিদ গীতি’ নামে একটি বই দিয়ে সহায়তা করেন, যে বইটি জনাব আব্দুল তাহিদ সাহেবের মৃত্যুর দুই মাস পূর্বে স্বনামধন্য মেধাবী কবি ও সাহিত্যিক জনাব মাস্টার আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। আমাদের শিক্ষক সমাজের প্রবীণ শিক্ষাগুরু বর্তমানে খুবই অসুস্থ হবিবপুর কিশোরপুরের সন্তান জনাব মাস্টার আব্দুল ওয়াদুদ স্যারের জন্য দোয়া ও শ্রদ্ধা রইলো। উনার ঐ লেখনীর জন্যই আমি এক নবীণ নারী আমারই নিজের গোষ্ঠীর এক প্রবীণ পুরুষের অজানা অনেক তথ্য জানতে পারলাম। পৃথিবীর সকল সুন্দর মনের মানুষের জন্য আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা রইলো।
লেখক:প্রধান শিক্ষিকা, ৩ নং হবিব পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।