রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-
لَتُنْقَضَنَّ عُرَى الْإِسْلَامِ عُرْوَةً عُرْوَةً فَكُلَّمَا انْتَقَضَتْ عُرْوَةٌ تَشَبَّثَ النَّاسُ بِالَّتِي تَلِيهَا وَأَوَّلُهُنَّ نَقْضًا الْحُكْمُ وَآخِرُهُنَّ الصَّلَاةُ
“তোমরা একটি একটি করে ইসলামের হাতল ছাড়তে থাকবে। যখনই মানুষ একটি হাতল ছাড়বে, তখন তার নিচেরটি ধরবে। সর্বপ্রথম ছাড়বে হুকুম (আল্লাহর হুকুমের বদলে অন্যের হুকুমে শাসনকার্য চলবে) এবং সবার শেষে ছাড়বে নামাজ।” [মুসনাদে আহমদ, ২২১৬০]
রাসূলুল্লাহ ﷺ যে ইসলাম কায়িম করেছেন, সেই ইসলাম একটি দ্বীন বা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের নিজস্ব হিদায়াত রয়েছে। ইসলামের রয়েছে নিজস্ব এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আকীদা, ইবাদাত, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, পারিবারিক নীতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসায়নীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থা, যুদ্ধনীতি, নিজস্ব বন্ধু ও নিজস্ব শত্রু। এইসব স্বতন্ত্র বিধিবিধানের দ্বারা ইসলাম এক মজবুত হাতলে (العُرْوَة الْوُثْقَىٰ) পরিণত হয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম এই হাতল পুরোপুরি আঁকড়ে ধরেছিলেন। আমরা এক এক করে প্রতিটি হাতল ছেড়ে দিচ্ছি।
আমরা যখন ইসলামের একটি হাতল ছেড়ে দেই, তখন এর বদলে সেই জায়গায় অন্য কোনো হাতল আঁকড়ে ধরি। প্রথমে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ছেড়ে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের হাতল ধরেছি। ইসলামি অর্থনীতি ছেড়ে পুঁজিবাদ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর হাতল ধরেছি। ইসলামি আইন ও বিচারব্যবস্থা ছেড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী আইন গ্রহণ করেছি। ইসলামি সমাজ ও সংস্কৃতি আজ পশ্চিমা মিডিয়া-সন্ত্রাস ও বাঙালিয়ানার তুড়ে বিদায় নিতে বসেছে। ব্যক্তিজীবনে আমরা নামাজ পড়ি ঠিক, কিন্তু এক সময় এই শেষ হাতলও ছেড়ে দেব।
এই যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এর নাম সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজম একটি স্বতন্ত্র জীবনব্যবস্থা, যার নিজস্ব রাষ্ট্রনীতি, অর্থব্যবস্থা, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, আইন ও সংস্কৃতি রয়েছে। এগুলোকে কবুল করে, এর অধীনে ব্যক্তিগত জীবনে কে কোন ধর্ম পালন করল, তাতে সেক্যুলারিজম মাথা ঘামায় না। ইসলাম কেবল একটি ধর্ম হলে সেক্যুলারিজমের সাথে এর কোনো দ্বন্দ্ব থাকত না। কিন্তু ইসলাম তো কেবল ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে দ্বীন। ইসলামের একটি নিজস্ব এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা রয়েছে। রাসূল ﷺ বলেছেন, “ইসলাম সর্বদা উঁচু থাকে। এটি কখনও নিচু (অধীনস্থ) হয় না।” [সুনান দারুকুত্বনী, ৩৬২০]। এখানেই ইসলাম ও সেক্যুলারিজমের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মনে রাখবেন, সেক্যুলারিজম মানে ধর্মহীনতা নয়। সেক্যুলারিজম মানে দ্বীনহীনতা।
সেক্যুলারিজমের দাসত্ব কবুল করে নেয়ার পর আমরা যখন এই ব্যবস্থার ভেতর জোর করে ইসলামকে ফিট করার চেষ্টা করি, তখন ফলাফল হয় হাস্যকর। ধরুন, একটি আম গাছে ছয়টি ডাল আছে। এক ব্যক্তি পাঁচটি ডাল কেটে দিল। এরপর কাটা অংশে একটি করে জাম, আতাফল, ডালিম, খেজুর ও আঙুরের ডাল তার দিয়ে পেঁচিয়ে লাগিয়ে দিল। ওসব ফলের গায়ে আমের রঙ লাগিয়ে বলল, সবগুলোই আম। এই বিষয়টি যতটা উদ্ভট হবে, সেক্যুলারিজমের ভেতর ইসলামকে জোরপূর্বক প্রবেশ করানোও ঠিক তাই। কারণ এক কোষে দুই তরবারি কিভাবে থাকবে? এই দুটি আলাদা দুই জীবনব্যবস্থা।
সেক্যুলার ব্যবস্থায় ইসলামকে ফিট করার দুটি হাস্যকর উদাহরণ হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ইসলামি ব্যাংকিং। একটি আপাদমস্তক সেক্যুলার সংবিধানের মধ্যে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ লিখে রাখার ফায়দা কী, বা ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শব্দটির অর্থ-ইবা কী, সেটিও আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। রাষ্ট্রধর্ম অর্থ যদি হয়, রাষ্ট্র যে ধর্মের আদর্শ অনুযায়ী চলবে, সে ধর্ম। তাহলে আমাদের রাষ্ট্র কোথাকার ইসলামি বিধি অনুযায়ী চলছে? বরং রাষ্ট্রধর্ম শুনলেই মনে হয়, রাষ্ট্রের অধীনস্থ একটি ধর্ম। কিন্তু ইসলাম কোনো রাষ্ট্রের অধীনস্থ হতেই পারে না। ইসলামের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা আছে। তাই রাষ্ট্র হয় ইসলামের বিধি অনুযায়ী চলবে, নয়ত চলবে না। মাঝখানের পথ খোলা নেই।
একইভাবে সুদি অর্থব্যবস্থার অধীনে ইসলামি ব্যাংকিং বলে কিছু নেই। কারণ সুদি অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদ বা সমাজবাদকে অনুসরণ করে। ইসলাম পুঁজিবাদ নয়, সমাজবাদও নয়। ইসলামের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি অর্থব্যবস্থা রয়েছে। সম্পূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্র ব্যতীত অন্য কোথাও ইসলামি অর্থনীতি ফাংশন করতে পারে না। তাই সেক্যুলার ইসলাম, মডারেট ইসলাম, ইসলামি পুঁজিবাদ, ইসলামি সমাজতন্ত্র, ইসলামি নারীবাদ বলে আসলে কিছু নেই। যেভাবে ইসলামি মদ, ইসলামি জুয়া বা ইসলামি ব্যভিচার বলে কিছু নেই। এগুলো সবই আল্লাহর বিধানের সাথে ইয়ারকি করার সমতুল্য।
আসুন, আমরা মানুষের কাছে ইসলামের সঠিক ও পরিপূর্ণ শিক্ষা পৌঁছে দেই। ‘ধর্ম’ ইসলামের কথা বহু বলা হয়েছে। এবার ‘দ্বীন’ ইসলামের কথা বলি। যে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ, স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে ইসলাম হাশরের ময়দানে আমাদের মুক্তির সোপান হবে। আল্লাহ বলেছেন-
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [সুরা আলে ইমরান, ৮৫]
লেখকঃ মারজান আহমদ চৌধুরী
তরুণ ইসলামী আলোচক ও গবেষক।