শিক্ষার্থীদের দ্বারা কোনো শিক্ষককে জনসম্মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা আদবসংশ্লিষ্ট বা ন্যায়সঙ্গত কাজ নয়। যদিও কোনো শিক্ষক বৈষম্য, দুর্নীতি আর শত শত অন্যায়-অনীয়মের সাথে জড়িত থাকেন, তবুও তাঁদের সম্মানজনকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। জনসম্মুখে কোন শিক্ষককে অপমান করা বা পদত্যাগে বাধ্য করা শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
জনসম্মুখে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা কেন অনুচিত, তার যৌক্তিক আলোচনা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. ন্যায়বিচার ও আইনসঙ্গত প্রক্রিয়া:
ন্যায়বিচার একটি মৌলিক অধিকার, যা সবার জন্য প্রযোজ্য, এমনকি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের জন্যও। জনসম্মুখে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, কারণ এতে অভিযোগের সঠিক তদন্ত বা প্রমাণের জন্য কোনো সুযোগ থাকে না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অভিযোগগুলি তদন্ত করার জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, যা শিক্ষকদের সঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়। এক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, তবে এটি বিচারপ্রক্রিয়ার মূল নীতিমালা লঙ্ঘন করে এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের দিকে পরিচালিত হতে পারে।
ন্যায়বিচার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন—
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ۚ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তাদের মালিকদের কাছে পৌঁছে দাও এবং যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার করো, তখন ন্যায়বিচার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উত্তমভাবে উপদেশ দেন।”
(সুরা নিসা, ৪:৫৮)
◾এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমানত রক্ষা করার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিয়েছেন। আমানত বলতে কোনো দায়িত্ব, অর্থ বা সম্পদের দায়িত্ব বোঝানো হতে পারে। একজন শিক্ষকও আমানতের অধিকারী, কারণ তিনি তার ছাত্রদের জ্ঞান দানের দায়িত্ব পালন করেন। এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, শিক্ষকদের তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত, এবং অন্যদেরও তাদের সঙ্গে সুবিচার করা উচিত। এই আয়াতটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বও তুলে ধরে, যা ইসলামের একটি মৌলিক নীতি।
২. সম্মান ও মর্যাদা:
শিক্ষক পেশাটি সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, এবং শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে শিখে থাকে। জনসম্মুখে শিক্ষকদের অপমান করা তাদের সম্মানকে ক্ষুণ্ন করে এবং শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করে। সম্মানজনক আচরণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষকের প্রতি অশোভন আচরণ শিক্ষার্থীদের জন্যও নেতিবাচক উদাহরণ স্থাপন করে।
সম্মান রক্ষা ও কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তায়ালা বলেন—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ
“হে মুমিনগণ, তোমরা একে অপরকে উপহাস করো না। হতে পারে, উপহাসকারীরা তাদের চেয়ে উত্তম, যাদের উপহাস করা হচ্ছে।”
(সুরা হুজুরাত, ৪৯:১১)
◾এই আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের একে অপরকে উপহাস করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিচ্ছেন। কাউকে উপহাস করা মানে তার মান-সম্মানকে হানি করা। ইসলামে প্রতিটি ব্যক্তির সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আয়াত শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের সম্মান রক্ষার এবং জনসম্মুখে তাদের সম্মানহানী থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। শিক্ষকদের যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে তা একান্তে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।
৩. প্রত্যাঘাতের ঝুঁকি:
যদি শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের জনসম্মুখে পদত্যাগে বাধ্য করতে শুরু করে, তবে এটি ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের মধ্যে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করতে পারে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস এবং প্রতিহিংসার সৃষ্টি হতে পারে, যা শিক্ষার গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়া, শিক্ষার্থীরা যদি জানে যে তারা জনসম্মুখে এমন পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে তা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শিক্ষার পরিবেশের সুষ্ঠুতা বিনষ্ট করতে পারে।
৪. গঠনমূলক সমাধান এবং শিক্ষার পরিবেশ:
শিক্ষার পরিবেশ গঠনমূলক, সহযোগী, এবং পরিপূর্ণ হতে হবে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগগুলি সঠিক প্রক্রিয়ায় এবং সম্মানজনকভাবে উত্থাপন করা উচিত। জনসম্মুখে পদত্যাগে বাধ্য করার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযোগ প্রক্রিয়া থাকতে পারে যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে এবং সেগুলির উপর সঠিক তদন্ত ও সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
৫. বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা:
শিক্ষার্থীদের এমন আচরণের ফলে শিক্ষকেরা আরও প্রতিকূল হতে পারেন এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন। এতে শিক্ষার মান কমে যেতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হতে পারে। অন্যদিকে, একটি সম্মানজনক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলে শিক্ষকেরা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং ভবিষ্যতে উন্নতি করতে পারে।
৬. নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ:
একজন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা শুধু একাডেমিক নয়, বরং নৈতিক শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা যদি জনসম্মুখে কাউকে অপমান করে বা বাধ্য করে, তবে তারা নিজেদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। নৈতিক শিক্ষা শিক্ষা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি শিক্ষার্থীদের একজন ভালো নাগরিক হতে সাহায্য করে।
৭. সমাজের ভূমিকা:
সমাজের প্রত্যেক সদস্যের উচিত অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। জনসম্মুখে একজন শিক্ষকের পদত্যাগে বাধ্য করা সামাজিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এর ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হতে পারে। এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং এর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে।
উপরের যৌক্তিক কারণগুলির আলোকে, জনসম্মুখে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা অনুচিত এবং এর পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের উচিত অভিযোগের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা।
লেখক: শাহ্ আলম সজীব
শিক্ষার্থী, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা