• ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

শাহরিয়ার ভাই মজা করে বলতেন কই বা প্রেসিডেন্ট

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত এপ্রিল ১০, ২০২১
শাহরিয়ার ভাই মজা করে বলতেন কই বা প্রেসিডেন্ট

লতিফুর রহমান রাজু:১৯৮৪ সালের শেষ দিকে সাংবাদিক জগতে আমার পদচারনা। তখনকার দিনে পত্র পত্রিকা  এতো ছিল না। সাংবাদিক ও হাতে গোনা কজন ছিল সীমান্ত জেলা সুনামগঞ্জে। আমি সিলেট থেকে প্রকাশিত প্রয়াত সাংবাদিক মহিউদ্দিন শীরু ভাইর সম্পাদিত সাপ্তাহিক গ্রাম সুরমা ও হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দৃষ্টিকোণ পত্রিকার সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি।  সংবাদের কিছুই বুঝিনা। পরিচয় হয় সাংবাদিক রণেন্দ্র তালুকদার পিংকুর সাথে। পরে তার মাধ্যমেই প্রয়াত সাংবাদিক রেজা ভাইর সাথে পরিচয়।রেজা ভাই বসতেন সুরমা মার্কেটের গলিতে নিজ  প্রেস ও সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ পত্রিকার অফিসে।দৈনিক সংবাদের ও জেলা প্রতিনিধি ছিলেন। এর পর ফখরু ভাই, ডিয়ার চন্দন দা , প্রয়াত শাহজাহান আফিনদি ভাই ,কালাম ভাই, ফোরকান ভাই, ননীদা ,নিরঞ্জন দা বন্ধু আতিক সহ অনেকের সাথে পরিচয় ,ওটাবসা, সিনিয়র দের কাছ থেকেই যা শিখার কিছুটা শিখেছি। তাদের উৎসাহেই আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আস্তে আস্তে আরো অনেক অগ্রজ অনুজ দের সাথে পরিচিত হই। কিছুদিন পর প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখি ,আবেদন ও করি তখনকার সভাপতি প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম রব্বানী ও সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সাংবাদিক কামরুজ্জামান চৌধুরী সাফী ভাই বরাবর। কিন্ত সদস্য করা হয়না কারণ তখনকার সময়ে একটি আইন ছিল যদি কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সদস্য অমত করেন তাহলে সদস্য করা হবে না। এভাবেই আমি পিংকুদা সহ অনেকেই আটকা পরলাম। যাক কিছুদিন পর প্রেসক্লাবের সদস্য মনোনীত হই। খুব সম্ভবত ১৯৯০সালে প্রেস ক্লাবের নির্বাচন নিয়ে দুটি প্যানেল সৃষ্টি হয়। একটি প্যানেলে তখনকার দৈনিক বাংলার জেলা প্রতিনিধি এডভোকেট আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন, দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিনিধি হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী,বিটিভি প্রতিনিধি এডভোকেট আইনুল ইসলাম বাবলু,সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ সংবাদ সম্পাদক দেওয়ান ইমদাদ রেজা চৌধুরী , নির্বাহী সম্পাদক ইশতিয়াক শামীম সহ অন্যান্যরা। আরেক প্যানেলে       সাপ্তাহিক   স্বজন  পত্রিকার ব্যাবস্থাপনা সম্পাদক সৈয়দ তাহের আলম মনসুর,  সাপ্তাহিক স্বজন সম্পাদক এড‌ভো‌কেট শহীদুজজামান চৌধুরী,দৈনিক ইনকিলাব  প্রতিনিধি  ম, ফ,র,ফোরকান,নিরঞ্জন তালুকদার,  দৈনিক সংবাদ প্রতিনিধি  রণেন্দ্র তালুকদার পিংকু,  দৈনিক বাংলার বাণী প্রতিনিধি  লতিফুর রহমান রাজু,   ডেইলী অবজারভার করেসপনডেনট   শেরগুল আহমেদ,  দৈনিক আজকের কাগজ প্রতিনিধি আবেদ মাহমুদ চৌধুরী,সহ আরো অনেকেই। শেষ পর্যন্ত আর নির্বাচন হয়নি বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে দীর্ঘদিন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। কোনভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছেনা। ঐ সময় সুনামগঞ্জ আসেন ছুটি কাটাতে সাংবাদিক চৌধুরী হাসান শাহরিয়ার ভাই।  আমরা শাহরিয়ার ভাইর হাছন নগরস্হ  বাসায় দু পক্ষের লোকজন আসা যাওয়ার কারণেই শাহরিয়ার ভাই কে অনুরোধ করি সমস্যার সমাধান করতে। আমাদের সাথে শাহরিয়ার ভাইর অগ্রজ এডভোকেট হোসেন তওফিক চৌধুরী ভাই ও জোর দেন। যাক বেশ কিছুদিন আলাপ আলোচনার পর শাহরিয়ার ভাইর হস্তক্ষেপে দুই পক্ষের   দুজন কে     বড় দুটি পদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আর বাকী পদ ভাগ করে দিয়ে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রেস ক্লাব যাত্রা শুরু করে। সভাপতি সাফী ভাই সাধারণ সম্পাদক মনসুর ভাই। অভিষেক অনুষ্ঠান ও জাকঁজমকভাবেই হয়। ঐ সময় থেকেই কীর্তিমান সাংবাদিক সুনামগঞ্জের গর্বের ধন শাহরিয়ার ভাইর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়।   জানতে পারি উনার গৌরবের কাহিনী ।   আমাকে খুব আদর করতেন। উনি সুনামগঞ্জ আসলেই আমরা সবাই বাসায় দল বেঁধে দেখা করতাম, আড্ডা দিতাম, আর তওফিক ভাই মজার মজার খাবার খাওয়াতেন। এভাবেই চলছিল বেশ কিছুদিন পর আবার শুরু হয় ঝামেলা। এক পর্যায়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বলি । প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রে ছিল পর পর দুই বার কেউ সভাপতি প্রার্থী হতে পারবেন না। দুই বারের পর একবার গ্যাপ দিয়ে আবার প্রার্থী হওয়া যাবে। কিন্ত সাফী ভাই গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করেই পর পর দুই বার সভাপতি থাকার পরও আবার প্রার্থী হন। দেখা দেয় মহা সমস্যার।  অনুরোধ করেও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমাকে সভাপতি প্রার্থী করা হয়। তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন প্রয়াত শিক্ষক আব্দু মিয়া। তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেও সমাধান না পেয়ে আমি সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে অভিযোগ দাখিল করলে আদালত নির্বাচন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তিতে আবার শাহরিয়ার ভাইর হস্তক্ষেপে সমাধান হয়। ঐ সময় থেকেই শাহরিয়ার ভাই আমাকে   মজা করে   বলতেন কই বা প্রেসিডেন্ট। শাহরিয়ার ভাই মজা করে প্রেসিডেন্ট বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত আমার ভাগ্যে প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বর্তায়।
 এক সময় আমি  প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করি এটিও অনেক ঝুট ঝামেলার পর। তখনকার সময়ে বেশ বেশ বড় বড় অনুষ্ঠানাদি হয় শাহরিয়ার ভাইর সহযোগিতায়।
২০০৪সালে সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিজেএ সভাপতি চৌধুরী হাসান শাহরিয়ার কে সম্বর্ধনা প্রদান করা হয় আমার সভাপতিত্বে । যা আমার জন্য এটি একটি বিশেষ সন্মানের ও সৌভাগ্যের। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন   বিএনপির সংসদ সদস্য তৎকালীন হুইপ এডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়া , বিশেষ অতিথি ছিলেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীন,সিলেট প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুকতাবিস উন নুর ,জেলা প্রশাসক মোঃ জাফর সিদ্দিক।
এছাড়াও শাহরিয়ার ভাইর সহযোগিতার কারণে ঢাকা থেকে অনেক সাংবাদিক দের সুনামগঞ্জ নিয়ে আসা হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
একবার সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন তথ্য মন্ত্রী কে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রেস ক্লাবে আনার। তখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায়,আর তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুনামগঞ্জের আরেক কিংবদন্তি আব্দুস সামাদ আজাদ। শাহরিয়ার ভাইর সাথে আলাপ করলে উনি বলেন দেখো তোমরা তথ্য মন্ত্রী আনতে চাইলেও উনি সামাদ সাহেব কে না বলে আসবেন না । তোমরা এক কাজ করো সামাদ আজাদ সাহেব কে দাওয়াত করো সাথে তথ্য মন্ত্রী বাকীটা যা করার আমি করব । যেমন কথা তেমন কাজ। সামাদ আজাদ সাহেব সাথে তথ্য প্রতি মন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ এবং আরো এক ঝাঁক তারকা সাংবাদিক জাতীয় লেভেলের নিয়ে আসলেন শাহরিয়ার ভাই। 
খুব সম্ভবত ১৯৯৫ সাল প্রেস ক্লাবের সদস্যদের বায়না শাহরিয়ার ভাইর কাছে আমরা পিআইবির ট্রেনিং দিতে চাই। শাহরিয়ার ভাই পিআইবির ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করলেন তাও পুরো টীম সুনামগঞ্জ এসে সপ্তাহ ব্যাপী ট্রেনিং করিয়েছেন।  এ রকম আরো অনেক আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজন হয়েছিল শাহরিয়ার ভাইর সহযোগিতায় । সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সদস্য গণ
শাহরিয়ার ভাইর ঋণ কোন শোধ করার নয়, কারণ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
উপমহাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার ১৯৪৪ সালের ২৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বিন্নাকুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী অবিভক্ত আসাম-বাংলার বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, খেলাফত আন্দোলনের নেতা ও ভাষা সংগ্রামী ছিলেন।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা ‘যুগভেরী’র (১৯৩২) প্রথম সম্পাদক। সিলেটের ‘যুগবাণী’ (১৯২৫) ও কলকাতার দৈনিক ‘ছোলতান’ (১৯৩০) পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। হাসান শাহরিয়ার ৬০-এর দশকে দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর পাকিস্তানের করাচিতে পড়াশুনা ও দৈনিক ডন পত্রিকায় সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেন। একইসাথে সেখানে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি ছিলেন।

সত্তরের দশকের শুরুতে ঢাকায় এসে দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ শুরু করেন। এই পত্রিকায় তিনি কূটনৈতিক রিপোর্টার, চিফ রিপোর্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৮ সালে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে অবসর নেন। ইত্তেফাকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিখ্যাত সাময়িকী নিউজ উইক, দুবাইয়ের খালিজ টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ডিকান হেরাল্ড, এশিয়ান এজ, পাকিস্তানের মর্নিং নিউজসহ বহু বিখ্যাত সংবাদপত্রে কাজ করেছেন।দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।সম্পাদক ছিলেন ডেইলী সান ও ডেইলী পিপলসের। কানাডা ভিত্তিক কমনওয়েলথ জার্নালিস্টস এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক প্রেসিডেন্ট-এমিরিটাস ছিলেন তিনি। ওকাবের (ওভারসিজ করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সভাপতিসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।

লেখক: সভাপতি,  সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটি।