আরিফুর রাহমান মানিক, ছাতক(সুনামগঞ্জ)প্রতিনিধি,
বান্দরবানে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গি উগ্রবাদী এ সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ছাতকে রুফু মিয়া। সিলেট অঞ্চলে জামাতুল আনসারের প্রচার শাথার প্রধান সহযোগি সদস্য বলে র্যাব জানিয়েছে।
রুফু মিয়া (২৬)’র বাড়ি হচ্ছেন সুনামগঞ্জ জেলায় শিল্প নগরী ছাতক উপজেলার ছৈলা ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের রাড়ীগাঁও গ্রামের কৃষক আব্দুস সালামের তৃতীয় পুত্র।
গত ২০ অক্টোবর রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্বে র্যাব-৭ ও ১৫ অভিযান চালিয়ে ১০ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে একজন সুরা সদস্যের বাড়ি হচ্ছেন ছাতকে। সে বেশী ভাগ সময় ঢাকা,চ্রটগ্রাম সিলেট,সুনামগঞ্জের সীমান্তবতী এলাকায় ফেরিওয়ালা সেজে জঙ্গি সংগঠনের কাজ করতো।
র্যাব জানায়, ২০২১ সালে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সাথে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল হিন্দার শারক্বিয়া’র সম্পর্ক গড়ে উঠে। যার প্রেক্ষিতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মাসিক চুক্তিতে কাজ শুরু করে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী এই সংগঠনটি। চুক্তি অনুযায়ী কেএনএফ’কে মাসিক ৩ লাখ টাকা এবং তাদের সদস্যদের খাবার খরচ বহন করতো নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটি।
র্যাব জানায়, অভিযানের সময় এসবিবিএল বন্দুক ৯টি, এসবিবিএল বন্দুকের ৫০ রাউন্ড গুলি, কার্তুজ কেইস ৬২টি, হাত বোমা ৬টি, কার্তুজ কেইস (এসএ) ১টি, কার্তুজ বেল্ট দুটি, দেশীয় পিস্তল ১টি, ওয়াকিটকি ১টি, ওয়াকিটকি চার্জার ১টি, দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র ও প্রপোজড অব কুকি-চিন স্টেট লেখা দশটি মাত্রচিত্র উদ্ধার করেছে।
র্যাবের লিখিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে থাকা জামাতুল আনসারের সদস্য সংখ্যা ৫০ জনের বেশি। সংগঠনটির আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। উগ্রবাদী এ সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্যের মধ্যে রয়েছেন ছাতকে রুফু মিয়া নাম অন্যতম।
রুফু মিয়া ফেরিওয়ালা সেজে অস্ত্র চালানসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনা করেছেন সিলেটের বিভিন্ন চা বাগান এলাকায়। সে বেশী সময় বাড়িতে না থেকে বসবাস করছেন সিলেটে থাকেন। তারা সিলেট অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হতে চা পাতা,মোবাইল কাভার, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রবাদি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করত।
তারা সিলেট,সুনামগঞ্জসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করত। তারা ফেরিওয়ালা সেজেই এসব অবৈধ জঙ্গি সংগঠনের কাজ চালায়।পুলিশ ও র্যাব সুত্রে জানায়,গ্রেপ্তার মারুফ আহমেদ ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামি হাফেজ নাঈমের আপন ছোটো ভাই। তিনি সিলেট অঞ্চলে জামাতুল আনসারের প্রচার শাখার প্রধান এবং সামরিক শাখার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি।এ শাখার প্রধান সহযোগি সদস্য হচ্ছেন রুফু মিয়া।
জানা যায়, সম্প্রতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া কয়েকজন তরুণের বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায়’ নামে নতুন এক জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পায় র্যাব। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে গত দুই বছরে বাড়ি ছাড়া ৫৫ তরুণের খোঁজ পেয়েছে তারা। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকাও তারা প্রকাশ করেছেন।এবার ১৭ জনসহ মোট ৫৫ জনের নাম প্রকাশ করা হয়।
এর আগে, র্যাবের পক্ষ থেকে রাজধানীতে একটি সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের কয়েকটি জেলা থেকে ‘নিখোঁজ তরুণরা’ পাহাড়ে একটি সশস্ত্র দলের ছত্রছায়ায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। অভিযোগ উঠে নতুনভাবে গড়ে উঠা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট(কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র দলে এই ‘নিখোঁজ তরুণরা’ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিন তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রুফু মিয়া
খিদ্ররা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ ৫ম শ্রেনী পাশ করেন। লাকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় ২০১৩ সালে এস এস সি পরীক্ষা পাশ করেন। পরে ২০১৫ সালে গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।২০১৫সালে শেষ দিকে এম,সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। কয়েক বছর বেকার থেকে বিভিন্ন দপ্তরের চাকুরীর জন্য আবেদন নিবেদন করার পর তার কোন চাকুরী হয়নি।
সে মেধাবী ছাত্র ছিলেন রুফু মিয়া। তার লেখাপড়ার করার পর তার চাকুরী না হওয়ার পর চরম প্রতাশ হয়ে পড়েছিল রুফু মিয়া।
অবশেষ ঢাকা থেকে একটি প্রাইভেট (চা পাতা) কোম্পানীতে সেলম্যান হিসাবে চাকুরী নেন রুফু মিয়া। দু বছর পর এই কোম্পানী থেকে তার চাকুরী চলে যায়। পরে ঢাকা থেকে মোবাইলের কাভার ইত্যাদি পন্য এনে ছাতক,গোবিন্দগঞ্জ,ধারনবাজার,জাউয়াবাজার,লাকেশ্বরবাজার,পীরপুর,দোলারবাজার,আলীগঞ্জ বাজার,মঈনপুর বাজার,বাংলাবাজার,ছৈলা বাজার,সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে কেনা বেচা করতো বলে একাধিক ব্যক্তিরা জানিয়েছে। তার একাধিক বন্ধুরা জানান,তার সঙ্গে ঢাকা চ্রটগ্রাম সহ বিভিন্ন জেলার অচেনা দাড়িওয়ালা লোকজন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গোপন মিটিং করতো। প্রায় সময় নিবরে থাকতো,কথা কম বলতো,পাড়াপড়শীর সঙ্গে তেমন দেখাও করতো না। বেশী সময় তার নিজ ঘরে বসে থাকতেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন।
তার গ্রামের জুবায়ের আহমদ রানা,শাহিন আহমদ ও আলী হোসেন জানান, সে একজন মেধাবী ছাত্র, ভদ্র ছেলে হিসেবে তার গ্রামে সবার কাছে পরিচিত ছিল।বেশীভাগ সময় সিলেটে লেখাপড়া করেছে। এজন্য তার গ্রামের লোকজনের সাথে যোগাযোগ কম ছিলো। ঢাকা- সিলেট বিভিন্ন জায়গা থেকে চা পাতা-মোবাইল মালামাল পণ্য ক্রয় করতে যেতো। পরিবারের ধারণা, ঢাকা-সিলেট সেখান থেকেই কোনোভাবে সে জঙ্গিবাদ সংগঠনে জড়িয়ে পড়েছেন।
তার বাবা একজন কৃষক আব্দুস সালাম ইরি ও বোর কৃষি কাজ করে জীবনজীবিকা চালাচ্ছেন। তার ছেলে জঙ্গি হতে পারে না।
তার বড় ছেলে রাজা মিয়া ওমানে থাকেন। তার মেঝ ছেলে নাছির মিয়া সিলেটের কাজী ম্যানশনের ৩য় তলায় ট্রেইলারি ব্যবসা করেছেন।
তার টিনের একটি ভাঙ্গা ঘর। জরাজীর্ণ অবস্থা। তার গ্রাম ও এলাকাবাসীদের কাছে তারা পরিবার ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত রয়েছে। এছাড়া ছৈলাআফজলাবাদ ইউপির ৫নং ওয়াডে আ`লীগের সহসভাপতি মৃত আব্দুল মনাফ মিয়ার আপন ভাতিজা বলে গ্রামবাসি নিশ্চিত করেন। তার পরিবারের সঙ্গে গ্রাম্য কোনো বিরোধ নেই।
রুফু মিয়ার বাবা আব্দুস সালাম এ প্রতিনিধিকে জানান,তার পুত্র প্রায় ১৫-১৬ দিন যাবৎ সে বাড়িতে কোন যোগাযোগ করছে না। তার ছেলে বড় হচ্ছে,বাড়ি বাইরে থাকবে। তার ছোট ছেলে কয়েক দিন ধরেই বাড়িতে আসছে না।
তার মা তাকে প্রায় বলতো রুফু মিয়ার খোজ নেন, তখন তার বার বার ফোন করলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাই।
গত ২১, অক্টোবর ছাতক থানায় গিয়ে জিডি করবো। এর মধ্যেই তার বড় ভাই ওয়াড আ`লীগের সহসভাপতি আব্দুল মনাফ মিয়ার মৃত্যু বরন করে।
ঐদিন বিকেলে তার আত্মীয় স্বজনেরা তার বাবাকে ফোনে জানায় তার ছেলে বান্দরবানে জঙ্গিদের হয়ে কাজ করতে গিয়ে র্যাব বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
এব্যাপারে তার চাচাত্বো ভাই নানু মিয়া জানান,সব সময় কাজে কামে ব্যস্ত থাকতাম। তার সঙ্গে কথা কম হতো। তার বাবা মারা যান গত শনিবার (২১ অক্টোবর) আব্বার জানাজায় ছৈলাআফজলাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান গয়াস আহমদ সহ সকল শ্রেনীর শত শত মানুষ তার বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এসময় তার চাচাতো ভাই রুফু মিয়া উপস্থিত ছিলেন না। তবে ঐ বিকালে শুনেছি সে জঙ্গি সদস্য হওয়ায় র্যাব বাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন বান্দরবানে। সে এমনভাবে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়বে আমাদের কল্পনায়ও ছিলো না।
এব্যাপারে ছৈলাআফজালাবাদ ইউপির চেয়ারম্যান গয়াস আহমদ জানান,রুফু মিয়ার বাবা আব্দুস সালাম গ্রামের একজন ভদ্র মানুষ হিসেবে সবাই তাকে জানেন এবং চিনেন।এ পরিবারের বিরুদ্ধে কেউ ও কোন অভিযোগ নেই। সেই ব্যাক্তির সন্তান শিক্ষিত ছেলে এমন কাজ করবে তা কল্পনা করতে পারছি না । তবে বিষয় আমাদের জন্য লজ্জাজনক!
এব্যাপারে ওসি মাহবুবুর রহমান জানান,সে গ্রেপ্তারের পর থেকে তার পরিবারের খোজ খবর নিচ্ছেন পুলিশ।
এব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবু সাঈদ এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে
বলেন, তার সম্পর্কে আরো গভীরভাবে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। এ দেশে জঙ্গির সংগঠনের কোনো ছাড় নেই ।সুনামগঞ্জ জেলায় এসব সংগঠনের স্থান নেই।