লতিফুর রহমান রাজু, সুনামগঞ্জ: গত কদিনের টানা বর্ষন ও সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। কিন্ত বানভাসী মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ কমেনি। জেলার ৫টি উপজেলা ছাতক,দোয়ারাবাজার, তাহিরপুরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গাতেই প্লাবিত হয়ে সড়ক, বসতঘর,বিদ্যালয় পানিতে নিমজ্জিত হয়। জেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট সহ খাবার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। আজ শনিবার থেকে পানি খুবই ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। সড়ক গুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার চিত্র খুবই খারাপ ছিল। প্রশাসন চাল, নগদ অর্থ, শুকনো ও রান্না
করা খাবার বিতরণ করছে ঠিকই কিন্ত তা পর্যাপ্ত নয় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ গত ৪ দিন ধরে পানিবন্দি। ডুবে গেছে বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট। যে সড়কে নিয়মিত যান চলাচল করতো তা এখন পানির দখলে থাকায় সেখানে চলছে ছোট ছোট নৌকা। নৌকায় যাতায়াত করছেন নাগরিকরা। শহরের পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন শহরের খাল বিল ও জলাধার ভরাট করার ফলে এই নাগরিক দুর্ভোগে নাকাল শহরবাসী। এ কারণে বন্যা বিলম্বিত হবে, পানি কমবে ধীরে। সমাজ কর্মী সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন সুনামগঞ্জ শহরের বেশ কটি বড় বড় খাল ছিল যেমন কামার খাল, তেঘরিয়ার খাল, বড়পাড়ার খাল , ষোলঘর খাল কিন্ত এই সব খর স্রোতা খাল গুলো কিছু অবৈধ দখলদার দীর্ঘদিন ধরেই দখল করে ঘর বাড়ি,দোকান পাট,স্কুল মসজিদ সহ অন্যান্য স্হাপনা নির্মাণ করার ফলে সামান্য পানি আসলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। অবিলম্বে এসব খাল পুনরুদ্ধার করে পৌরসভার নাগরিক দের স্বস্তি দানের দাবী জানান।
বন্যায় এই স্বচ্ছল মানুষজনের থাকা খাওয়ার সমস্যা না হলেও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষজন বিপাকে পড়েছেন। যারা কাচা ঘরে বসবাস করতেন তাদের বসতঘর ধ্বসে যাচ্ছে। এদিকে সুনামগঞ্জ শহরে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ২সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গুড়িগুড়ি ও ঝুম বৃষ্টিপাতও হচ্ছে মাঝে-মধ্যে। গত ২৪ ঘন্টায় সুনামগঞ্জে ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, রেকর্ড করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের (বর্ধিত এলাকা) কালিপুর, ওয়েজখালি, বড়পাড়া, হাজিপাড়া, পশ্চিম হাজিপাড়া, তেঘরিয়া, পূর্ব নতুনপাড়া, নতুন হাসননগর, নবীনগর, হাসনবাহারসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই এলাকার সবগুলো আভ্যন্তরীণ সড়ক ডুবে গেছে। বসত বাড়িগুলোও নিমজ্জিত। কারো ঘরে পানি, কারো উঠোনে, ছুই ছুই করছে। ঘরে মাচা করে বা প্রতিবেশির উচু ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিতে দেখা গেছে অনেক পরিবারকে। অনেকে আশ্রয় না পেয়ে পুলিশ লাইন্স সংলগ্ন বিসিক ক্যাম্পাসে, রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদিপশু নিয়ে এসে রাখছেন পুলিশ লাইন্স ও বিসিক চত্বরে। নিমজ্জিত পরিবারগুলোর পায়খানা ও নলকুপ পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। তাই বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন সমস্যায় আছেন তারা।
কালিপুর গ্রামের পিয়ারা বিবি বলেন, আমার বসতঘরে পানি ছুই ছুই করছে। কিন্তু গোয়ালঘরে হাটু পানি। এখন দুটি গরুকে বসতঘরের বারান্দায় এনে রেখেছি। গোখাদ্য হিসেবে বৈশাখে সংগৃহিত খড় পানিতে ভেসে গেছে। এখন আরেক বাড়ি থেকে কিছু কাঠালপাতা ও কদমগাছের পাতা নিয়ে এসেছি। মানুষ কোনভাবে নিজেকে বাচিয়ে নিতে পারলেও গবাদিপশু নিয়ে এখন টেনশনে আছে।
একই গ্রামের জহুরা বিবির টিনশেডের বসতঘরে হাটুপানি। যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় মাচার উপর সন্তানদের নিয়ে বসে আছেন। অপেক্ষা করছেন পানি নেমে যাওয়ার। জহুরা বিবি বলেন, চাইর দিকে পানি, ভাত ফুটাইতে পারিনা, পানি খাইতে পারিনা। অনে কিভাবে চলতাম।
কালিপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামকে দেখা গেল তার নিমজ্জিত ঘরের বারান্দায় একটি ছোট নৌকায় চার ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে তুলে রওয়ানা দিয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়ায় তার স্ত্রী ও সন্তানদের শশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে নৌকা নিয়ে এসেছেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘরো পানি উঠে গেছেগা। অনে খানিখাদ্যের অসুবিধা। পোকা মাকড়, সাপ বিচ্ছুর ডর আছে। বাইচ্চাকাইচ্চারে অন্য জাগাত পাঠাই দিছি।
ওয়েজখালি এলাকার হতদরিদ্র নারী রাহেনা বেগম বলেন, কিছুদিন আগে ঘর নিছে তুফানে। অনে পাইিন্যে ঠেলা দিয়া ঘর ডোবাই লিছে। এখন কোয়াই যাইমু। পানির উফরে আছি। ঘরো খাওন দাওন নাই। আরেক বাড়িত তনি চাইট্টা খানি আনছি।
প্যানেল মেয়র আহমদ নূর বলেন, আমাদের পৌরসভার বর্ধিত এলাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। গত চার দিনে এসব এলাকার সব রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। ৭০ ভাগ মানুষের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। নদী খাল পুকুর ভরাট এবং হাওর ভরাট করে পাড়া মহল্লা গড়ে ওঠার কারণে জলাধার কমে গেছে। এ কারণে এসব এলাকা এখন নিয়মিত বন্যায় নিমজ্জিত হয়।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, আমার পৌরসভায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বাস। এর মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ নিয়মিত শহরে অবস্থান করেন। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এবারের বন্যায় পানিবন্দি হয়েছে।
আমাদের বর্ধিত এলাকার বেশিরভাগ মানুষজনের বসতঘর এখন নিমজ্জিত। প্রায় ষাট হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। যাদের বেশিরভাগ বসঘরই নিমজ্জিত। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় তারা চলাফেরা করতে পারছেনা। বানভাসী এসব মানুষদের সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা এনে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ১৬৫ মে.টন চাল নগদ অর্থ ১২ লক্ষ টাকা বিতরণের পর আবারও বন্যা দুর্গতদের জন্য আরো বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছি। বন্যায় সার্বিক ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার সব প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান তিনি। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার কতটি পরিবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার ৭ হাজার ২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।