।। এনামুল হক ।। উজান থেকে নেমে আসা চেলা আর সুরমা বিধৌত ছাতক – দোয়ারা অঞ্চলের আশ্বিনের ভাটার স্রোতের সুরমার ঢেউ যেনো হঠাৎ থমকে গেলো। পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন ছাতকের উত্তর সুরমাবাসীর রত্ন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ডাক্তার আব্দুর রহিম।
রত্নের চির বিদায়ে কাঁদছে উত্তর সুরমার প্রতিটি জনপদ। কারো কাছে ডাক্তার সাব আর কারো কাছে চেয়ারম্যান সাব নামেই ছিল যে বট বৃক্ষ তা আর কখনো ছায়া হয়ে দাড়াবেনা উত্তর সুরমাবাসীর জন্য।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর্য পেয়ে রাজনীতিতে যার অভিষেক হয়েছিল আলোর প্রদীপ হয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন এদেশে আওয়ামীলীগ করার মতো সাহসী মানুষের অভাব ছিল তখনই চরম দু:সময়ে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডাক্তার আব্দুর রহিম ছাতক-দোয়ারা আসন থেকে নৌকা মার্কা নিয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
সামান্য ভোটে পরাজিত হলেও তিনি মানুষের মনি কোঠায় স্থান করে নেন। এরশাদ শাসনামলে প্রথম বারের মতো উপজেলা পরিষদ গঠন হলে তিনি নবগঠিত দোয়ারা বাজার উপজেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে সততা দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর সেই দায়িত্বকালে অবহেলিত দোয়ারা বাজারের গ্রামীণ অবকাঠামো রাস্তা নির্মাণ মাটি ভরাট, গ্রামীণ বাজার গুলোর উন্নয়ন সহ একটি জনপদের জন্য প্রাথমিক যে ভিত্তি তৈরি করা প্রয়োজন ছিল তা তার হাত ধরেই নির্মাণ হয়েছিল।
তিনি নবগঠিত দোয়ারাবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান হলেও তিনি ছিলেন অভিভক্ত ছাতক উপজেলা সদরের বাসিন্দা। ফলে গোটা ছাতক দোয়ারার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক বটবৃক্ষ।
নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষহীন ডাক্তার আব্দুর রহিম প্রচলিত রাজনীতির নোংরা প্রতিযোগিতায় গা ভাসাননি বলে পরবর্তীতে আর কোন নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন দৌড়ে যাননি।
তাঁর সমসাময়িক রাজনীতিবিদরা অনেকেই কয়েক বারের এমপি মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু নির্লোভ ডাক্তার রহিম তার চিরচারিত খেয়াঘাটের ছোট্ট ফার্মেসীতে বসে গরীব অসহায় মানুষের চিকিৎসা সেবায় গোটা জীবন পার করেছেন।
অনেক সময় নামাজ শেষে তাঁকে মসজিদের সিড়িতে বসে তসবিহ পড়তে দেখা যেতো। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও প্রতিদিন সাত সকালে তিনি পুকুরে সাতার কাটতেন।
জীবনের শেষ বিকালে তাকে জনগণ আবারও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু প্রশাসনিক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে তিনি জনগণের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছিলেননা। তার একাধিক বক্তব্যে তিনি বুঝিয়েছেন তিনি মানুষের জন্য কাজ করতে পারছেননা। অনেক সময় তিনি যা বিশ্বাস করতেন সরল মনে অকপটে প্রকাশ করতেন। তিনি কোন সংকোচবোধ করতেননা।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার মারাত্মক টনসিল সমস্যা ছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েও কমছিল না। আব্বার সাথে ছিল উনার প্রচণ্ড সখ্যতা। তিনি যখনই ফ্রি থাকতেন আব্বাকে ফোন করে উনার চেম্বারে ডেকে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা এলাকা সমাজ রাজনীতি সব বিষয়ে উনাদের অনির্ধারিত টক শো চলতো।
টনসিল সমস্যা নিয়ে আব্বা আমাকে ডাক্তার সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে একটা ইনজেকশন দিলেন। সেই থেকে এখন পযর্ন্ত আমার টনসিল আর প্রবলেম করেনি।
একবার মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে হাটুতে ব্যথা পেয়ে তাঁর চেম্বারে ছুটে যাই। তিনি দেখে আমার হাতে নাপা ধরিয়ে দিয়ে আদুরে সুরে ধমক দিয়ে বললেন বেটা ঢং ঔষধের দরকার নাই। প্রতিদিন সকালে পুকুরে সাতার কাটলেই এই সমস্যা কেটে যাবে। ঔষধ ছাড়া রোগী বিদায় দেওয়ার মতো চিকিৎসক আজকাল কি কল্পনা করা যাবে?
তাঁর চেম্বারে ভাল উন্নত মানের কোয়ালিটি কোম্পানি ছাড়া আজেবাজে কোম্পানির ঔষধ রাখতেননা। গোটা উত্তর সুরমাবাসীর কাছে তিনি ছিলেন এক মহান নেতা আস্থাশীল চিকিৎসক।
আজ ডাক্তার আব্দুর রহিম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি মানুষের সেবায় কাজ করেছেন। তিনি গণমানুষের নেতা ছিলেন।
তিনি যে সামাজিক সমস্যার সমাধানের বিচারে অংশ নিয়েছেন তা সমাধান করেই এসেছেন। তাঁর কথা সিদ্ধান্ত কেউ অবজ্ঞা করেননি।
আজকালের ভাড়াটিয়া ৫শ আর এক হাজার টাকার ভাড়ায় খাটা কথিত বিচারিক অসাধু ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ তার নাম ব্যবহার করে আশেপাশে থেকে ফায়দা লুটার চেষ্টা করলে তিনি তাদের চরম ভাবে ঘৃণা করতেন।
এমন বটবৃক্ষের চিরবিদায়ে উত্তর সুরমাবাসী আজ অভিভাবকহারা। আমরা আমাদের একজন রত্নকে হারিয়েছি।
আল্লাহ তার বান্দাকে মাফ করে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের ধৈর্য্য ধারনের তৌফিক দিন। আমীন।