এমজেএইচ জামিল:সিলেটে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে সর্বোচ্চ ৮ বার ও সাড়ে ৩ ঘন্টার মধ্যে ৬ বার ভূমিকম্প নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সিসিকের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা ও ১০ দিনের সতর্কতাবস্থা নিয়ে জনমনে বিরাজ করছে আতংক। জৈন্তাপুর থেকে উৎপত্তি হওয়া ৮ বারের মৃদু ভূমিকম্পে সিলেট শহর কেপেঁ উঠলেও টের পায়নি খোদ জৈন্তাপুরের মানুষ। এমনকি শহরতলীর টুকেরবাজার, দক্ষিণ সুরমা ও মেজরটিলা খাদিমপাড়ার মানুষও ভূমিকম্প টের পায়নি। শুধুমাত্র শহরেই একদিনে এত বার ভূমিকম্পের ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে বিরল। সিলেট শহরের কিংবা তৎপাশর্^বর্তী এলাকায় মাটির নিচে কোন বিস্ফোরণ অথবা খনিজ সম্পদের কোন খনিতে বিষ্ফোরণের কারণেও এমনটা ঘটে থাকতে পারে বলেও আশংকা বিশেষজ্ঞদের। আর যদি সত্যিকার অর্থেই একাধিকবার ভূমিকম্প হয়ে থাকে তাহলে আগামী ১০ দিন সিলেটবাসীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ। এছাড়াও কম্পনগুলো ভূমিকম্প কি না, নাকি কোন বিষ্ফোরণ তা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ সহ অনেকে।
দেশের প্রখ্যাত ভূ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব সিলেটের ভূমিকম্পের বিষয়ে বলেন, সিলেট হচ্ছে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। এখানে ভূমিকম্প হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে জৈন্তাপুর থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প শহর ছাড়া আশেপাশের এলাকাগুলোতে অনুভুত না হওয়ায় আমার আশঙ্কা মাটির অভ্যন্তরে কোন খনিজ সম্পদের খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হতে পারে। এমনকি পাশর্^বর্তী রাষ্ট্রে মাটির নিচে কোন মারণাস্ত্র স্থাপনের ফলেও এমন কম্পন হতে পারে। ভূপৃষ্টের নিচে ফাটল সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়। আবার ফাটল বন্ধ হলেও ভূমিকম্প হয়। শনিবার সিলেটে ঘটা একাধিকবারের কম্পন যদি ভূমিকম্প হয়ে থাকে, তাহলে এমনটি হতে পারে ভূপৃষ্ঠের নিচের ফাটল ধীরে ধীরে পূর্বের জায়গায় ফিরে গেছে। এই দিক থেকে পরবর্তীতে বড় ভূমিকম্প নাও হতে পারে।
দৈনিক জালালাবাদের সাথে আলাপকালে তিনি আরো বলেন, একটি অঞ্চলে ১০০ থেকে ২০০ বছর পর পর একটি বড় ভূমিকম্প হয়। এই হিসাবে সিলেট অঞ্চলে ১৮৯৭ সালে বড় ভূমিকম্পের পর ১২৩ বছর পেরিয়ে এসেছে। এই কারণে বড় ভূমিকম্প হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্তই মেনে চলতে হবে। যে কোন এলাকায় বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। এই দিক থেকে একাধিকবার ভূমিকম্প মূলত বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা। সিলেট ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে আগামী ১০ দিন সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বনের বিকল্প নেই। এছাড়া এই কম্পনগুলো ভূমিকম্প কি না, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজ নেয়া উচিত।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে আগামী ১০ দিনের জন্য সিলেটবাসীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ড. রব বলেন, ঝুকিপূর্ণ ভবনগুলো থেকে যত দ্রুতসম্ভব জনসাধারণকে সরিয়ে নিতে হবে। বিশেষ করে রাতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। সবসময় পাশে পানি ভর্তি বোতল রাখতে হবে এবং টেবিলের নিচ খালি রাখতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ যত দ্রুত সম্ভব বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এক কথায় ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে সিলেট নগরবাসীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সর্বোপরি আল্লাহর কাছে বিপদ আপদ থেকে সুরক্ষার জন্য বিশেষ মোনাজাত করতে হবে। কারণ কোন দুর্যোগই আল্লাহর হুকুমের বাইরে নয়।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য থেকে জানা গেছে, শনিবার (২৯ মে) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৩ মাত্রার, সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ৫৩ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৪.১ মাত্রার, ১১টা ২৯ মিনিট ৫১ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ২.৮ মাত্রার এবং ১টা ৫৮ মিনিটে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রোববার (৩০ মে) সিলেটে খুবই কম মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ২.৮।
ঢাকা ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, মাত্র ২.৮ মাত্রার মতো খুবই স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প অনুভব করার কারণ হলো অল্প গভীরে ভূমিকম্প হওয়া। এ জন্য মানুষ বুঝতে পারছে। যেখানকার মানুষ ভূমিকম্প বুঝতে পারছে, তাদের খুব কাছে ইপি সেন্টার বা উৎপত্তিস্থল। উৎপত্তিস্থল মানে হলো যেখানে ভূমিকম্প হয় তার মাটির নিচের যে জায়গাটা সেটাকে বলা হয় ফোকাস। সেই ফোকাস থেকে লম্ব বরাবর বা সোজা উপরের ভূমিকে বলা হয় ইপি সেন্টার। কম মাত্রার বা ছোট ছোট ভূমিকম্পের পরে একটা বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকে। এর মানে এই নয় যে, সেটা ছয় মাস বা এক বছর পর হবে। এটা ২০ বছর পরেও হতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, এটা ইন্ডিকেট করছে, ওই জায়গাটা (সিলেট) স্ট্রেচফুল (চাপে আছে)। ওই অঞ্চলটা ভূমিকম্পের জন্য পটেনশিয়াল অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু কম মাত্রার কম্পন প্রায়ই অনুভূত হচ্ছে, এখন থেকে সতর্কতামূলক অবস্থানে যেতে হবে। আশপাশে যেসব ভবন তৈরি করা হচ্ছে, বিষয়গুলো করার সময় এ ঝুঁকি বিবেচনায় নিতে হবে।
শাহজালালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বিগত দিনে হওয়া ৭/৮ বারের ভূমিকম্প নিয়ে আমরা নিজেরাও সন্দিহান। কারণ একদিনে এতবার ভূমিকম্প হওয়ার রেকর্ড নাই। ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৩ বার হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। ভুমিকম্প সত্যিকার অর্থে ৭ বার হয়েছি কিনা তাও ঠিক করে বলা যাচ্ছেনা। এই কম্পন যে শুধু ভূমিকম্প সেটাও পুরোপুরি মনে হচ্ছেনা। সিলেটের মাটির নিচে কোথাও কোন বিষ্ফোরণের কারণে এমনটা ঘটতে পারে। সিলেটের খনিজ সম্পদের খনিগুলোর অভ্যন্তরে কিছু ঘটে থাকতে পারে। সেভরন নিয়ে সন্দেহ করা অস্বাভাবিক নয়। যদি তারা কোন বিষ্ফোরণ না ঘটিয়ে থাকে তাহলে ভালো।
তাছাড়া ভারতের মেঘালয় রাজ্যে পাহাড় কেটে পাথর বের করে ডিনোমাইট দিয়ে পাথর ফাটিয়ে চুনাপাথর ও সিমেন্ট তৈরী করা হয়। সে কারণেই কম্পন হতে পারে। সিলেটের ভূমিকম্প নিয়ে ভারত এবং আসামেও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে বলে আমরা শুনতে পেয়েছি। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে জৈন্তাপুর বলা হলেও এটা নিশ্চিত নয়। যার কারণে জৈন্তাপুরের মানুষও কম্পন অনুভব করেনি। শুধু শনিবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল সারিনদী সংলগ্ন ভারতের করিমগঞ্জ ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি বলেন, আসাম টু ডাউকি ফল্টের ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব রয়েছে। তাই এই সীমানার কোন প্রান্তে কম্পন হলে অন্যপ্রান্তে তা অনুভব নাও হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন আগে পঞ্চগড়ের কাছে জলপাইগুড়িতে বেশ কয়েকটা ভূমিকম্প হয়েছে। সেটার কম্পনও বাংলাদেশে হয়েছে। একইভাবে ভুটানের ভূমিকম্পের কম্পনও বাংলাদেশে হয়েছে। সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্ট আছে, এখানেও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার পূর্বাঞ্চলের সেগিং ফল্টের দিকেও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা আছে। এই প্লেট বাউন্ডারিগুলো সবই আমাদের খুবই কাছে। সে কারণে এভাবে ভূমিকম্পগুলো হয়ে থাকে। তাই ভূমিকম্পের ব্যাপারে আতংকিত না হয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সদ্য সিলেটে ঘটা কম্পনগুলো ভূমিকম্প কিনা সেটা নিয়ে জনমনে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সন্দেহ দূর করতে প্রয়োজন উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের।