আব্দুল গাফফার চৌধুরী: আমি আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক, এ কথাটা কোনোদিন লুকাইনি। লুকিয়ে নিরপেক্ষতার ভান করিনি। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি। তাই বলে আওয়ামী লীগের সরকার কোনো ভুলত্রুটি করলে তার সমালোচনা করব না, এমনটা নয়। সমর্থন ও চাটুকারিতা এক কথা নয়। আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক, চাটুকার নই। তাই সাম্প্রতিক সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনায় আওয়ামী লীগকে সতর্ক না করে পারছি না। কারণ, আমি নিজেও একজন সাংবাদিক।
আমলাতন্ত্র কখনোই রাজনৈতিক সরকারকে পছন্দ করে না। তারা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সরকারকে আনুগত্য দেখায়। তলে তলে এমন সব কাজ করে, যার দায়ভার রাজনৈতিক সরকারকেই পোহাতে হয়। রাজনৈতিক সরকার জনপ্রিয়তা হারায়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালানোর হুকুম তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন দেননি। দিয়েছিলেন তার সরকারের পাঞ্জাবি চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদ। কিন্তু তার দায়ভার বহন করতে হয়েছে নূরুল আমিনকে। তিনি শুধু জনপ্রিয়তা হারাননি, তার রাজনৈতিক জীবনও শেষ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সন্ত্রাসী সিরাজ সিকদারকে হত্যার নির্দেশ দেননি। তিনি তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসাররা তাকে বন্দি করার পর হত্যা করেছে। এর দায়ভার বহন করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। তার রাজনৈতিক শত্রুপক্ষ তার বিরুদ্ধে আর কোনো প্রচারণা চালাতে পারেনি। বারবার সিরাজ সিকদার হত্যার ধুয়া তুলেছে।
খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল দু’জন পুলিশ কনস্টেবল (সঙ্গে পুলিশের গাড়িচালক)। ইয়াসমিন দরিদ্র শ্রমিককন্যা। ঢাকার কর্মস্থলে কাজ সেরে রাতের বাসে বাড়ি ফিরছিল। পথে পুলিশ কনস্টেবলের লালসার শিকার হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেজন্য ওই পুলিশ কনস্টেবলদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে প্রচার করতে শুরু করেন ইয়াসমিন ছিল রাস্তার পতিতা। ভাবখানা এই, রাস্তার পতিতারা যেন মানুষ নয়। তাদের ইচ্ছামতো ধর্ষণ এবং হত্যা করা যায়। পরে তো সাংবাদিকদের অদম্য প্রয়াসে আসল সত্য প্রকাশ প্রায় এবং খালেদা জিয়া সরকারকে এর দায় বহন করতে হয়।
এ ধরনের ঘটনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের দৃঢ়তা ও সাহসের আমি প্রশংসা করি। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় আসল সত্য চাপা দিতে তিনি দেননি বরং ব্যক্তিগত দায়িত্বে অপরাধীদের, যাদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাও ছিলেন, গ্রেপ্তার ও বিচারে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানে যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধা করেননি। কিন্তু কথায় বলে, ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’। শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে অভিযুক্তদের তো ধরা হয়েছে; কিন্তু আমলাতন্ত্রের ‘ফসকা গেরো’র সুযোগে তারা এখনও আরাম-আয়েশে আছেন কিনা বলতে পারব না।
সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেও আমার আশা ছিল হাসিনা সরকার অপরাধীদের পালিয়ে বেড়াতে দেবে না। বরং এই হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হবে এবং অপরাধীরা, তারা সমাজের যত উচ্চস্তরেই থাকুক, তাদের ধরা হবে এবং শাস্তি পাবে। কিন্তু বছরের পর বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থা এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারেনি। বোঝাই যায়, এ ব্যাপারে তদন্তকারী পুলিশদের হাত-পা বাঁধা। কিন্তু সেজন্য পুলিশ বিভাগকে নয়, দায় পোহাতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারকে।
রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের ঘটনায় নানা রং চড়ানো হয়েছে। তিনি একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যদি কোনো অন্যায় আচরণ করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করাই ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সেটা না করে তাকে আট ঘণ্টা সচিবালয়ে আটকে রেখে মানসিক শাস্তি দেওয়া (শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়েছে কিনা জানি না), তারপর পুলিশ ডেকে তাকে থানায় হস্তান্তর করা, তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার আগেই তাকে আটক রাখা কোনোটাই স্বাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না।
একজন নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করার জন্য দুঃখ প্রকাশের পরিবর্তে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যে রুদ্ধমূর্তি দেখা গেল, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না রোজিনা ইসলাম তার জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে হোক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কায়েমি স্বার্থে আঘাত করেছেন। নইলে তিনি যদি রাষ্ট্রের কোনো তথ্য পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাকে ‘অন্যায় করেছি, আর করব না’ এই মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া কেন?
বুঝতে বাকি থাকে না, বিএনপি আমলে ইয়াসমিন নামে এক তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার পর যেমন অপরাধ ঢাকার জন্য তাকে রাস্তার পতিতা বানানোর চেষ্টা হয়েছিল, তেমনি সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে অবৈধভাবে আটকে রাখার পর স্বার্থসংশ্নিষ্ট মহল সম্মিলিত সাংবাদিক-জনতার প্রতিবাদের মুখে একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও তার চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে।
প্রথম কথা, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে গোপনীয় চুক্তি সম্পাদনের ফাইলটি যদি রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে এতটা জড়িত থাকে, তাহলে সচিবদের তত্ত্বাবধানে কোনো সুরক্ষিত স্থানে তা থাকার কথা। সেটি কোনো পিএ বা পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের টেবিলে অরক্ষিত অবস্থায় থাকে কীভাবে?
আরও একটি কথা। জানা গেল রোজিনা ইসলাম সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে টিপস পেয়েছিলেন, তিনি সচিবালয়ে গেলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবেন। এই টিপস তাকে সচিবালয় থেকে কে বা কারা দিলেন? রোজিনা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। এ কথা জেনেই কি তাকে স্বার্থসংশ্নিষ্ট কোনো মহল ট্র্যাপে ফেলার জন্য এই কাজটি করেছে?
রোজিনার ঘটনাটি নিয়ে মামলা হওয়ায় এ সম্পর্কে বেশি কথা বলার অবকাশ কম। কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায়, বহুদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে, রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধিৎসু রিপোর্টে অতীতে তা প্রকাশ পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রকাশ পাবে। এজন্যই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই নাটকটির ব্যবস্থা করেছে- এটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। রোজিনা ইসলাম একজন অনুসন্ধানী রিপোর্টার। তথ্য সংগ্রহের জন্য তাকে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। সেই ঝুঁকি নিয়ে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেপরোয়া দুর্নীতি উদ্ঘাটনে গিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে যে বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ চলছে তাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উচিত ছিল পদত্যাগ করা। স্বাস্থ্য সচিবকেও এই মন্ত্রণালয় থেকে অপসারণ করা উচিত।
রোজিনাকে কেন্দ্র করে যে নাটকটি তারা করলেন তাতে বিশ্বসমাজে বাংলাদেশ এবং হাসিনা সরকারকে সমালোচিত হতে হচ্ছে। ব্রিটেন, আমেরিকার সংবাদপত্রে তা প্রথম পাতায় লিড নিউজ হিসেবে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের সমালোচকরা বলার সুযোগ পেয়েছেন, বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নেই। প্রধানমন্ত্রী আপ্রাণ পরিশ্রম করে বাংলাদেশের জন্য সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়ে আনছেন, আর তাতে চুনকালি মাখছেন তারই একশ্রেণির আমলা। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো মন্ত্রী।
অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের অনেক সময় স্বাভাবিক পন্থার বাইরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার সেই কাজটি করেছিলেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর জড়িত থাকার খবর ফাঁস করেছিলেন। তাকে সেজন্য রাষ্ট্রের গোপন তথ্য পাচারের দায়ে হেনস্তা করা হয়নি। সেই রিপোর্টার বিশ্বময় প্রশংসিত হয়েছেন এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
আমার অনুমান, ঢাকাতেও রোজিনা ইসলামের মতো অনুসন্ধানী প্রতিবেদকরা আরও সুযোগ পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে যদি তথ্যানুসন্ধান করতে পারতেন, তাহলে দুর্নীতির এই জঞ্জাল দূর হতো। দেশের মানুষের অশেষ উপকার হতো। এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সরকারের গোপনীয়তা ফাঁস হলে ক্ষতি নেই। দেখতে হবে রাষ্ট্রের স্বার্থ ও নিরাপত্তা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়। রোজিনা যে রাষ্ট্রের সেই স্বার্থ ও গোপনীয়তা পাচার করেননি তা তাকে ট্র্যাপ করার ধরন দেখেই বোঝা যায়। একটি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার ফাইল এমন উপেক্ষিতভাবে একজন পিএসের ঘরে টেবিলে পড়ে থাকতে পারে না। খবরেই বলা হয়েছে, ঘরের দরজাটি ছিল খোলা।
রোজিনা রাষ্ট্রের গোপন তথ্য পাচারের চেষ্টা করে থাকলে এ ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে থানা পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগকে জানাতে হতো। তা না করে আট ঘণ্টা তাকে সচিবালয়ে আটকে রেখে হুমকি-ধমকি দেওয়া হলো কেন? তাকে যখন আদালতে তোলা হয়েছে তখন মাননীয় বিচারকরা নিশ্চয়ই ঘটনার গুরুত্বহীনতা বুঝতে পেরেছেন। তাই তাকে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করে দেন।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বময় মিডিয়ায় রোজিনার ঘটনা নিয়ে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে, সে কথা দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা রোজিনার বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে দেখব।’ রোজিনা যদি রাষ্ট্রের কোনো গোপন তথ্য পাচার করে থাকতেন, তাহলে তথ্যমন্ত্রী এ কথা বলতেন না যে, সরকার রোজিনার ঘটনাটি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবেন।
সর্বশেষ খবরে জানতে পেরেছি, রোজিনাকে আদালতের জামিনদান আগামীকাল (রোববার) পর্যন্ত মুলতবি রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, দেশের মানুষের অভিযোগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি এখন পর্বতসমান। একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তারা কোটি কোটি টাকা লুটছে। তাদের সঙ্গে একশ্রেণির সাংবাদিকও ছুটেছেন। তাদের সবার মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। একা এক রোজিনার সাধ্য কি এই বাঘের লেজে পা দেয়? দূর বিদেশ থেকে রোজিনার বীর সাংবাদিকতাকে অভিনন্দন জানাই।
লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট,
একুশে গানের রচয়িতা ।
লন্ডন, ২১ মে, শুক্রবার, ২০২
দৈনিক সমকালের সৌজন্যে