• ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৪ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

নদী বাহিত পাথরের উৎস ও অবস্থান থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পাথর উত্তোলন এখন সময়ের দাবি

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত আগস্ট ৩১, ২০২৪
নদী বাহিত পাথরের উৎস ও অবস্থান থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পাথর উত্তোলন এখন সময়ের দাবি

বিবিএন ডেস্কঃ কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে নিম্নমানের পাথর আমদানি না করে নিজ দেশের পাথর কোয়ারী সমূহ থেকে উন্নত মানের পাথর উত্তোলনের সুযোগ করে দেয়া দরকার। এতে যেমন কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে তেমনি দেশের অর্থনীতিও হবে সমৃদ্ধ।

পাথরের উত্তোলনের প্রয়োজনীয়তা:
দেশের অবকাঠামো বিশেষ করে রেললাইন, রাস্তাঘাট, দালান-কোঠা, ব্রীজ, ব্যারেজ, কালভার্টসহ বিভিন্ন নির্মাণ শিল্পে পাথর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আবাসনসহ দেশের ক্রমবর্ধমান অবকাঠামো তৈরিতে পাথরের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশে পাথরের বিভিন্ন উৎস ও অবস্থানকে তিনটি বড় শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এগুলো হল:
(১) নদী বাহিত পাথর,
(২) সমতল ভূমির নিচে অবস্থিত পাথর এবং
(৩) পাহাড় টিলায় অবস্থিত পাথর।

উপরোক্ত ৩টি উৎসের মধ্যে পরিবেশ রক্ষায় সমতল ভূমির নিচে অবস্থিত পাথর এবং পাহাড় টিলায় অবস্থিত পাথর উত্তোলন না করে শুধু “নদী বাহিত পাথর” এর উৎস থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন পরিবেশের জন্য সহায়ক বলে আমি মনে করি। নদী বাহিত পাথর কোয়ারি থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বা সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং তা দেশের বিস্তির্ণ অঞ্চলকে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা থেকে রক্ষা করার অন্যতম একটি অবলম্বন হতে পারে।

নদী বাহিত পাথরের উৎস ও অবস্থান: বাংলাদেশের সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী ধলাই, পিয়াইন, ডাউকী, সারি, গোয়াইন ও চেলা নদীতে নদীবাহিত পাথর জমা হয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাশিয়া জৈন্তা পাহাড় হতে পাহাড়ি ঢলে প্রাকৃতিকভাবে পাথর ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশের নদীসমূহের তলায় জমা হয়। এরূপ পাথর কোয়ারি সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ, কানাইঘাট উপজেলার লুভাছরা, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, শ্রীপুর এবং বিছনাকান্দি এলাকায় অবস্থিত। এছাড়া শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় নদীবাহিত পাথর রয়েছে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর সীমান্ত বরাবর অধিকাংশ নদী উত্তরে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণে বাংলাদেশের ভিতর প্রবেশ করেছে। এই সমস্ত নদী মেঘালয়ে পাহাড়ি এলাকায় শিলং শিল্ড এর কেলাসিত কঠিন শিলা ক্ষয় ও চূর্ণ করে এনে বাংলাদেশের ভিতর পাহাড়ের পাদদেশে এবং নদীবক্ষে কঠিন শিলার নুড়ির মজুদ সৃষ্টি করেছে।

দেশের নদী বাহিত পাথর কোয়ারির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নরূপ—-

ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি:
সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাথর ও বালি আবহমান কাল থেকে বিভিন্নভাবে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এবং শিলং প্লাটুর পাথর ছরার মাধ্যমে এদেশে পতিত হয়ে বালি ও পাথর কোয়ারির সৃষ্টি করেছে। উক্ত কোয়ারিসমূহের বালি ও পাথর উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাশিয়া-জৈন্তা পাহাড় হতে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ধলাই নদীর মাধ্যমে জমা হয়ে বালি এবং পাথরের কোয়ারিতে পরিণত হয়েছে। এই কোয়ারির পাথর দেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত মানের।

লুভাছরা পাথর কোয়ারি:
সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার লুভাছরা পাথর কোয়ারির পাথর ও বালি আবহমান কাল থেকে বিভিন্নভাবে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় এবং শিলং প্লাটুর শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছরার মাধ্যমে এদেশে পতিত হয়ে বালি ও পাথর কোয়ারীর সৃষ্টি করেছে। উক্ত কোয়ারিসমূহের বালি ও পাথর উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাশিয়া-জৈন্তা পাহাড় হতে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে লুবা নদীর মাধ্যেমে জমা হয়ে বালি এবং পাথরের কোয়ারিতে পরিণত হয়েছে।

জাফলং পাথর কোয়ারি:
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পাথর কোয়ারির পাথর ও বালির প্রধান উৎস মেঘালয়ের পাহাড় ও শিলং প্লাটুর শিলাসমূহ। আবহমান কাল থেকে বিভিন্নভাবে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছরার মাধ্যমে বাংলাদেশে পতিত হয়ে বালি ও পাথর কোয়ারির সৃষ্টি করেছে। ছড়াসমূহ পাহাড়ের খাড়া ঢাল (Steep Slope) বেয়ে দ্রুত গতিতে পাথর ও বালি প্রবাহিত করে পাহাড়ের পাদদেশে বাংলাদেশ সীমান্তে সমতল ভূমিতে ও নদী বেয়ে জমা হয়েছে ও হচ্ছে। উক্ত কোয়ারিসমূহের বালি ও পাথর উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাশিয়া-জৈন্তা পাহাড় হতে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ডাউকি-পিয়াইন নদী দুটির মাধ্যেমে জমা হয়ে বালি এবং পাথরের কোয়ারিতে পরিণত হয়েছে।

বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি:
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারির পাথর ও বালির প্রধান উৎস ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় এবং শিলং প্লাটু। আবহমান কাল থেকে বিভিন্নভাবে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পিয়াইন নদীর (বিছনাকান্দি ছরা) মাধ্যমে এদেশে সমতল ভূমিতে পতিত হয়ে এ্যালুভিয়াল ফ্যান তৈরি করেছে যা পরবর্তীকালে বালি ও পাথর কোয়ারি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ফাজিলপুর পাথর কোয়ারি:
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার ফাজিলপুর পাথর কোয়ারির পাথরও আবহমান কাল থেকে বিভিন্নভাবে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছরার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে শিলং প্লাটুর পথে এদেশে পতিত হয়ে বালি ও পাথর কোয়ারির সৃষ্টি করেছে। উক্ত কোয়ারিসমূহের বালি ও পাথর উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাশিয়া-জৈন্তা পাহাড় হতে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে জাদুকাটা নদীর মাধ্যেমে জমা হয়ে বালি এবং পাথরের কোয়ারিতে পরিণত হয়েছে। সিলেট অঞ্চলের পাথর কোয়ারিতে প্রতি বছরই প্রচুর পরিমাণে নতুন পাথর জমা হচ্ছে।

শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার পাথর কোয়ারি:
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের পাদদেশ হতে সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশের শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বর্ষাকালে উজান থেকে পাহাড়ী ঢলের কারণে এ নদী ও অন্যান্য পাহাড়ী ছড়ার মাধ্যমে বিশেষ করে ঝিনাইগাতী উপজেলার গজণী, রাংটিয়া, নওকুচি, দুধনই প্রভৃতি সীমান্তবর্তী এলাকায় পাথরের বিস্তার ঘটে থাকে। মানের বিবেচনায় এ পাথর উন্নত না হলেও এ দুটি উপজেলায় প্রতিবছর নিয়মিত পাথর উত্তোলন করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও উক্ত এলাকার গারো পাহাড়ের অভ্যন্তরেও পাথর রয়েছে।

উপরোল্লেখিত বিভিন্ন কোয়ারিতে উত্তোলিত পাথরকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা:
(১) বড় পাথর বা বোল্ডার
(২) গ্রাভেল বা ভুতু এবং
(৩) সিঙ্গেল।
এছাড়া আরও এক প্রকার অতি ক্ষুদ্রাকার পাথর রয়েছে যাকে স্থানীয় ভাবে ৫-১০ বা বুজুরী বলা হয়। সারাদেশে বোল্ডার এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় এর অর্থনৈতিক মূল্য সর্বাপেক্ষা বেশি। এর পর পর্যায়ক্রমে গ্রাভেল বা ভুতু, সিঙ্গেল এবং ৫-১০ বা বুজুরীর স্থান। এছাড়াও প্রাকৃতিক ক্ষয়জনিত কারণে দুর্বল গাঠনিক ক্ষমতাবিশিষ্ট অপছন্দনীয় ময়লা আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত এক ধরনের পাথর পাওয়া যায় যা স্থানীয়ভাবে মরা পাথর হিসেবে পরিচিত এবং যার অর্থনৈতিক মূল্য অনেক কম বিধায় এর ব্যবহার সীমিত।

এক সময় পাথরের চাহিদার সিংহ ভাগই উপরে বর্ণিত নদী বাহিত পাথর কোয়ারি থেকে অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহের মাধ্যমে মেটানো হতো। নিকট অতীতে নদী বাহিত পাথরের উৎস থেকে বাণিজ্যিকভাবে পাথর উত্তোলন একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলে সিলেটসহ সারা দেশের বিভিন্ন পাথর অঞ্চলে বা পাথর কোয়ারিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিজ দেশের পাথর কোয়ারী সমূহ থেকে উন্নত মানের পাথর উত্তোলন বন্ধ রেখে চিহ্নিত কতেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ব্যবসায়ীক লাভের জন্য ডলার সংকটের এই দুঃসময়ে বিদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার খরচ করে নিম্ন মানের পাথর আমদানি করা হচ্ছে। এতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা না হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন দেশের রিজার্ভের মূল্যবান ডলার ব্যয় হচ্ছে একই সাথে পাথর উত্তোলন, পরিবহন ও বিপণন পেশায় নিয়োজিত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ক্রম হ্রাসমান ডলার তথা আমাদের রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখতে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের স্বার্থে দেশীয়/আভ্যন্তরীন সম্পদ আহরণ ও তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন না করে পরিবেশবান্ধব পাথর উত্তোলন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ ব্যুরো পাথর সমৃদ্ধ এলাকায় Environmental Impact Assessment (EIA) সম্পাদন করে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষে নদী বাহিত পাথরের উৎস থেকে পাথর উত্তোলন করা এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি যেমন সুরক্ষিত থাকবে তেমনি এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত লক্ষ লক্ষ বেকার শ্রমিকও ফিরে পাবে তাদের হারিয়ে যাওয়া কর্মের সন্ধান।

জনস্বার্থে এবিষয়ে বর্তমান সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

নোট: অনেকেই ভাবতে পারেন সিলেটের পাথর কোয়ারীতে আমাদের নজর পরেছে। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে জনস্বার্থে ও দেশের স্বার্থে যুক্তি দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। আমার বক্তব্য একান্তই আমার বিবেচনা প্রসূত। এই মতের যৌক্তিক ভিন্নতা কে আমি আগাম স্বাগত জানাই।