লতিফুর রহমান রাজু .সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলায় সংঘটিত চাঞ্চল্যকর ক্লু-লেস হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন হওয়ায় শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজন কুমার দাস।
তিনি জানান গত ১৫ এপএপ্রিল রাত সাড়ে ১০ টায় ধর্মপাশা থানাধীন ধর্মপাশা সদর ইউনিয়নের অন্তর্গত আতকাপাড়া গ্রামস্থ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বিল্লাল নুরীর মৎস্য ফিসারীর উত্তর পার্শ্বে বিল্লাল নুরীর ধান ক্ষেত হতে অর্ধগলিত লাশ পাওয়া যায়। উক্ত বিষয়ে থানা পুলিশ তদন্তে নেমে লাশের পরিচয় সনাক্ত করে। অর্ধগলিত লাশের পরিচয় হলো ধর্মপাশাধীন দক্ষিন নোয়াগাঁও গ্রামের মোঃ কারি মিয়া খানের ছেলে অটোচালক সাইকুল ইসলাম খান (২৭)। এ বিষয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ২০ এপ্রিল ধর্মপাশা থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়।
উক্ত মামলা তদন্ত করতে শুরু করলে গত ২৫ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৪ টায় ধর্মপাশা থানাধীন ১নং ধর্মপাশা সদর ইউনিয়নের অন্তর্গত কান্দাপাড়া গ্রামস্থ নিমাইকোনা হাওড়ের জনৈক সাহাব উদ্দিনের ধানী জমি থেকে ১টি মানব দেহের মাথার খুলি এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়ের সাথে থাকা ময়লাযুক্ত কাপড় উদ্ধার করা হয়। এ বিষয়ে থানা পুলিশ তদন্তে নেমে লাশের পরিচয় সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। লাশটি ছিল ধর্মপাশা থানার দশধরী গ্রামের মোঃ কামাল মিয়ার ছেলে অটোচালক হুমায়ুন কবির (২০)।এ বিষয়েও অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ২৯ এপ্রিল ধর্মপাশা থানায় আরেকটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়।
২টি মামলার ঘটনায় প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাইসহ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন অফিসারদের দিকনির্দেশনায় ধর্মপাশা থানার অফিসার ইনচার্জের নেতৃত্বে ধর্মপাশা থানা পুলিশের একাধিক টিম ধর্মপাশা থানাসহ নেত্রকোনা ও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় গত ১ মে হতে ৩মে পর্যন্ত ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে সন্ধিগ্ধ আসামিদের সনাক্ত করাসহ ৭ জন আসামিকে গ্রেফতার করে এবং চোরাইকৃত অটোরিক্সা উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নিয়ে আসে।
গ্রেফতারকৃতরা হলো ধর্মপাশা থানার দুধবহর গ্রামের মোঃ রতন মিয়ার ছেলে দেলোয়ার হোসেন দিলু (৩০), রফিকুল ইসলামের ছেলে আজিম উদ্দিন (২৫), একই গ্রামের মোঃ রফিকের ছেলে নুরুল আমীন (২২), মোঃ ময়না মিয়ার ছেলে রুবেল (২২), মোঃ আবুল কাসেমের ছেলে জাকিরুল ইসলামইমুল (২৪), একই থানার দক্ষিণ নোয়াগাঁওয়ের মোঃ স্বপন মিয়ার ছেলে কাউছারনিয়াশ () এবং নেত্রকোনা সদর থানার ঠাকুরকোনা গ্রামের মৃত গোলম রব্বানীর ছেলে সেলিম মিয়া (৩৫)।
প্রেসব্রিফিং এ জানানো হয় প্রথম ঘটনায়
আসামি রুবেলকে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উক্ত ২টি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এবং সে সহ আসামি দেলোয়ার হোসেন দিলু, আজিম উদ্দিন, নুরুল আমীন, জাকিরুল ইসলামইমুল, কাউছারনিয়াশা মিলে হত্যা করে বলে জানায়। তার দেওয়া তথ্যর ভিত্তিতে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা মডেল থানাধীন গোয়ারা গ্রাম থেকে সন্দিগ্ধ আসামি জাকিরুল ইসলামইমুল, আসমি কাউছারনিয়াশা, আসমি আজিম উদ্দিন’দের আটক করিয়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সকলেই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। আটককৃত আসমিদের আরো জিজ্ঞাসাবাদ করিলে তাহারা জানায় যে, চোরাইকৃত অটোরিক্সা ২টি নেত্রকোনা জেলাধীন ঠাকুরকোনা এলাকার সেলিম মিয়ার নিকট নিহত অটোরিক্সা চালক হুমায়ন কবিরের অটোরিক্সাটি ৩০, হাজার-টাকা মূল্যে এবং নিহত অটোরিক্সা চালক সাইকুল ইসলাম খানের অটোরিক্সাটি ৩৭, হাজার-টাকা মূল্য বিক্রয় করে। তথ্য মোতাবেক আটককৃত আসমিদের সহ নেত্রকোনা জেলার নেত্রকোনা সদর থানাধীন ঠাকুরকোনা এলাকার বাজার হইতে আসমি সেলিম মিয়াকে আটক করিয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, আসমি রুবেল ও আসমি জাকিরুল ইসলামইমুল’দ্বয় চোরাইকৃত অটোরিক্সা ২টি আসমি সেলিম মিয়ার নিকট মোট ৬৭, হাজার-(সাতষট্টি হাজার টাকা) মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করে। উক্ত অটোরিক্সা ২টি সেলিমের দেখানো ও আসমিদের সনাক্ত মতে উপস্থিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে গ্যারেজ হইতে উদ্ধার করা হয়। অতপর আটকৃকত আসমিদের দেওয়া তথ্য মতে জানা যায় যে, আসমি দেলোয়ার হোসেন দিলু নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানাধীন মেসার্স শুভ শান্তি নামক প্রেট্রোল পাম্পে কাজ করে। উক্ত তথ্য মোতাবেক প্রেট্রোল পাম্পে হইতে আসমি দেলোয়ার হোসেন দিলুকে আটক করলে এবং জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। পরবর্তীতে অত্র থানাধীন ১নং ধর্মপাশা সদর ইউনিয়নের অন্তর্গত দুধবহর গ্রামস্থ নুরুল আমীনকে তাহার নিজ বসত হইতে আটক করা হয়। উল্লিখিত আটকৃত সকল আসমিগণ সহ চোরাই উদ্ধারকৃত মৃত সাইকুল ইসলাম এর ১টি সচল অটোরিক্সা ও অপর মৃত হুমায়ন কবির এর অটোরিক্সার মোট ৪টি ব্যাটারী উদ্ধার করিয়া থানায় আসিয়া হাজির হই। মৃত হুমায়ন কবির এর অটোরিক্সার ভাঙ্গারি
আটককৃত আসমিদের পর্যায়ক্রমে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদে তাহারা জানায় যে, গত রমজান মাসের ৪/৫ রোজার দিন তারিখ ১৬ মার্চ ইফাতারী শেষে অত্র থানাধীন দুধবহর গ্রামস্থ আসমিদের বসত বাড়ীর পার্শ্বে কংস নদীর পাড়ে শিমুলতলা (শিমতলা)’তে আসমি দেলোয়ার হোসেন দিলু এর নেতৃত্বে আসমি রুবেল, নুরুল আমিন, জাকিরুল ইসলামইমুল, কাউছারনিয়াশা, আজিম উদ্দিন মিলে অটোরিক্সা চুরি করিবে মর্মে পরিকল্পনা করে। সে সময় প্রথমে সাইকুল ইসলাম খান এর অটোরিক্সা চুরি করিবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু সাইকুল সকল আসমির পরিচিত হওয়ায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। তখন দ্বিতীয় পরিকল্পনা মোতাবেক ঐ রাতেই দেলোয়ার হোসেন দিলুর কাছে থাকা দশধরী গ্রামের অটোরিক্সা চালক মৃত হুমায়ুন কবিরের মোবাইল নম্বর আসমি রুবেলকে দেয় এবং বলে যে, আগামীকাল যোগাযোগ করে বলবি যে, পরেরদিন সকলেই বেড়াইতে যাইবে বলিয়া পরিকল্পনা করে। সেই মোতাবেক ঘটনার দিন ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক রুবেল অটোরিক্সা চালক মৃত হুমায়ন কবিরকে ফোন দিলে সে অটোরিক্সা নিয়া নোয়াগাঁও গ্রামের রাস্তায় আসিলে সকল আসমিগণ অটোরিক্সায় উঠিয়া কান্দাপাড়া গ্রামস্থ নিমাইকোনা হাওড়ের রাস্তায় অটোরিক্সা রাখিয়া হুমায়ন কবিরকে সকল আসমিগণ ধরিয়া নিমাইকোনা হাড়রের ধান ক্ষেতে নিয়া আসমি দেলোয়ার হোসেন দিলু তাহার সঙ্গে থাকা গামছা দিয়া হুমায়ন কবিরের গলায় পেচ দিয়া জমিতে ফেলিয়া শ্বাসরোধ করে। হুমায়ন কবির ছটফট করিতে থাকিলে সকল আসমিগণ ভিকটিমের হাত, পা চেপে ধরিয়া আসমি আজিম উদ্দিন ভিকটিমের মুখের মধ্যে গামছা ঢুকাইয়া দেয় এবং চেপে ধরে। পরবর্তীতে ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মৃত দেহ ধান ক্ষেতের ভিতরে ফেলিয়া চলিয়া আসে এবং আসমি রুবেল ও জাকিরুল ইসলামইমুল অটোরিক্সা নিয়া আটককৃত আসমি সেলিম মিয়ার নিকটে ৩০, হাজার/-(ত্রিশ হাজার) টাকা মূল্যে বিক্রি করিয়া আসে। বর্ণিত ঘটনায় ভিকটিম মৃত হুমায়ন কবিরের পরিবার লোকজন নিখোঁজ সংক্রান্তে কোন প্রকার আইনী কার্যক্রম বা কোন জিডি না করায় এবং দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ায় লাশের কোন খোঁজ না থাকায় আসমিগণ পুনরায় অন্য ঘটনার ঘটানোর উৎসাহিত হয়। পরবর্তীতে
আরেকটি ঘটনার পরিকল্পনা করে এবং পূর্বের ঘটনার আসামী দেলোয়ার হোসেন দিলু, রুবেল, নুরুল আমিন, জাকিরুল ইসলামইমুল, কাউছারনিয়াশা, আজিম উদ্দিন রমজান মাসের শেষে দিকে আনুমানিক ৬ এপ্রিল সন্ধ্যার সময় ইফতারী শেষে পুনরায় সকল আসমিগণ মিলে দেলোয়ার হোসেন দিলুর নেতৃত্বে অত্র থানাধীন দুধবহর গ্রামস্থ আসমিদের বসত বাড়ীর পার্শ্বে কংস নদীর পাড়ে শিমুলতলা (শিমতলা) নিরিবিলি বসিয়া দক্ষিন নোয়াগাঁও এর সাইকুল ইসলাম খানের অটোরিক্সা নিবে মর্মে সিদ্ধান্তে উপনিত হইয়া ঐদিন সন্ধ্যায় সাইকুল ইসলাম খানের সহিত কথা বলে। সেই মোতাবেক ৮ এপ্রিল অনুমান ২টায় সাইকুল এর অটোরিক্সা করিয়া আসমি রুবেল ও জাকিরুল ইসলামইমুল নেত্রকোনা জেলাধীন সদর থানার অন্তর্গত ঠাকুরকোনা বাজারস্থ আসমি সেলিম মিয়ার দোকানে যায় এবং সেখানে সময় ক্ষেপন করে। পুনরায় ঠাকুরকোনা বাজার হইতে রওয়ানা দিয়া সন্ধ্যার পর পর অত্র থানাধীন আতকাপাড়া গ্রামের উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বিল্লাল নুরীর মৎস ফিসারীর কাছে আসে, সেখানে আগে থেকেই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক অপর ৪ জন আসমি দেলোয়ার হোসেন দিলু, নুরুল আমিন, কাউছারনিয়াশা, আজিম উদ্দিনগণ অবস্থান করিতে থাকে। যেহেতু মৃত সাইকুল ইসলাম খান এর সকল আসমিগণই পরিচিত সেই কারণে সকলে মিলিয়া অটোরিক্সাটি রাস্তার পার্শ্বে রাখিয়া গাঁজা খাওয়ার উদ্দেশ্যে উক্ত ফিসারীর উত্তর কোনে যায় এবং সেখান ৩০ মিনিট যাবত গাঁজা খাওয়ার কার্যক্রম চালায়। সে সময় আসমি রুবেল প্রশাবের বাহানা করিয়া একটু দূরে সড়ে তাহার নিজের কোমড়ে থাকা চামড়ার বেল্ট খুলিয়া চুপিসারে আসমি দেলোয়ার হোসেন দিলুর হাতে দেয়। সে সময় অতর্কিতভাবে দেলোয়ার হোসেন দিলু ভিকটিম সাইকুল ইসলাম খান এর গলায় বেল্ট দিয়ে পেচ দিয়া শ্বাসরোধ করে। উক্ত সময় ভিকটিম সাইকুল ছটফট করিলে অপর আসমিগণ মিলে হাত পা চাপিয়া ধরিয়া মৃত্যু নিশ্চিত করে। তার কিছুক্ষন পর সবাই মিলে ধরাধরি করিয়া উক্ত ফিসারীর উত্তর পার্শ্বে ধান ক্ষেতের মাঝামাঝি স্থানে ফেলিয়া চলিয়া আসে। পরবর্তীতে পুনরায় আসমি রুবেল ও জাকিরুল ইসলামইমুল অটোরিক্সা নিয়া আটককৃত আসমি সেলিম মিয়ার নিকটে যায় এবং ৩৭ হাজার-(সাতত্রিশ হাজার) টাকা মূল্যে বিক্রি করিয়া আসে মর্মে আসমিগণ স্বীকার করে।