হয়রানির শিকার এলাকাবাসী,প্রতিকার নেই যেন কোথাও
|| মুহাম্মদ ইলিয়াস, রাঙামাটি থেকে ||
রাঙামাটি বিদ্যুৎ বিভাগের অনিয়ম দূর্নীতি চরমে পৌঁছে গেছে। বৈদ্যুতিক লোডশেডিংয়ের সাথে যোগ হয়েছে নিত্যনতুন ফর্মুলায় গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের ঘটনা। তাদের ঘুষ বানিজ্য হতে তালিকাভুক্ত গ্রাহক সহ নতুন সংযোগ গ্রহণকারীরা কোনভাবেই রেহাই পাচ্ছে না। বিভাগটি দৃশ্যত: অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হওয়ায় দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ পড়েছে সীমাহীন বিড়ম্বনায়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাঙামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সাইফুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো: আবুল হাশেম সহকারী প্রকৌশলী ওয়াহিদুজ্জামান শীতল ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার কামাল মিলে গড়ে তুলেছে ৪ জনের একটি ঘুষ বানিজ্য সিন্ডিকেট। প্রতিষ্ঠানটির সেই সিন্ডিকেটের হাতে সাধারণ বিদ্যুৎ গ্রাহকরা জিম্মি হয়ে রয়েছে। চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।সরকারি বিধি বিধানের তোয়াক্কা করে না। এখানে তাদের কথাই অলিখিত আইন।
পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটির জনবহুল ৩ উপজেলা লংগদু, বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর খাগড়াছড়ির নিয়ন্ত্রণে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। জেলা সদর সহ ৭ উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে রাঙামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ। এই ৭ উপজেলা হলো, রাঙামাটি সদর, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও কাউখালী। বিভাগটির নিয়ন্ত্রণে সর্বমোট বিদ্যুৎ গ্রাহক ৭০ হাজার। । তার মধ্যে সদরের গ্রাহকের সংখ্যা ৩২ হাজার। গ্রাহকরা কমবেশি সর্বমোট প্রতি দিন ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। সেখানে বর্তমানে সরবরাহ পাচ্ছে মাত্র ৫/৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ । গড়ে ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটির মানুষ। চাহিদার তুলনায় যা খুবই সামান্য। যে কারণে ঘন্টায় ঘন্টায় লোডশেডিংয়ের মতো বিড়ম্বনা চেপে বসেছে গ্রাহকদের উপর। মারাত্মকভাবে কষ্ট পাচ্ছে রোগী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষ। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। প্রযুক্তির ব্যবহার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
একাধিক ভুক্তভোগী জানায়, বিভাগটির নিয়ন্ত্রনাধীন বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের ট্রান্সফরমারের ধারণ ক্ষমতার থাকার পরও ঘুষ না দিলে, ট্রান্সফরমারের ধারন ক্ষমতা নেই অযুহাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দানে গড়িমসি করে। আবার দাবি মোতাবেক ঘুষের টাকা পলে, ট্রান্সফরমারের ধারণ ক্ষমতার বেশি সংযোগ থাকার পরও নতুন দিতে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন সিন্ডিকেটভুক্ত ৪ জন। অথচ নিয়মনীতির মধ্যে থেকেও মাসের পর মাস প্রতিষ্ঠানটির কর্তা ব্যক্তিদের কাছে ধর্ণা দিয়ে নানান হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংযোগ না দিয়ে এসব গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রকৌশলী মো: আবুল হাশেম স্বীকার করেন, সিঙ্গেল ফেইজ আবাসিক/বানিজ্যিক সংযোগ ৭ দিনের মধ্যে এবং ডুয়েল ফেইজ আবাসিক/বানিজ্যিক সংযোগ ২৮ দিনের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করার নিয়ম রয়েছে। সেই নিয়ম মানছেন না কেন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে ইতস্তত করেন এ কর্মকর্তা।
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অতিসম্প্রতি
বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থানান্তরের জন্য শহরের লুম্বিনী এলাকায় কালি শঙ্কর পরিবারের কাছ থেকে নগদ ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহন করেন। মানিকছড়ি বিসিক শিল্প নগরীতে প্রি-পেইড মিটারে লোড বাড়িয়ে দেয়ার শর্তে রাজা মিঞা নামের এক গ্রাহকের কাছ থেকে নগদ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহন করে। এমনকি কালিন্দিপুর এলাকায় ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে দাবী করে জেলা পর্যায়ের এক আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের কাছ থেকেও টাকা নেয় সহকারী প্রকৌশলী আবুল হাসেম। বিদ্যুত বিল পরিশোধের পরও তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মো: মুছার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোববার (২১ মে) দুপুরে উল্লেখ্য গ্রাহকের সাথে বিতন্ডা তৈরি হয়। চলতি সালের ১৬ এপ্রিল শহরের হাসপাতাল এলাকার মৃদুল কান্তি ধর’র বহুতল ভবনের ১০টি ফাইল অনুমোদন হয়। কিন্তু একই সময়ে
ফাইল জমা দিলেও চাহিদা মতো ঘুষ দিতে ব্যার্থ হওয়ায়
জগৎ জ্যোতি চাকমার বৈদ্যুতিক সংযোগ দানে গড়িমসি করছেন। ফাইল ছাড়া সংযোগ দানের মতো নেক্কারজনক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও অনেক পুরোনো। তার সাথে হুকিং কানেকশন ও সঞ্চালন লাইন লাগোয়া গাছের ডালপালা কাটার নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ সহ নিত্যনতুন কায়দায় পকেটভারী করার মতো দূর্নীতিও কম নয়। চক্রটি ভুক্তভোগীদের একেকবার একেক অযুহাতে হয়রানি করছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে চরম অভ্যন্তরীণ বিরোধ।
শহরের বনরূপা, রিজার্ভ বাজার, কাঠলতলী ও তবলছড়িতে প্রায় ট্রান্সফরমারে ধারণ ক্ষমতার শতভাগ
সংযোগ দিয়েছেন। কিন্তু রাজবাড়ী কে কে রায় সড়ক এলাকায় ধারণ ক্ষমতার ৮০ শতাংশ পূর্ণ না হবার পরও কাল্পনিক অযুহাতে সংযোগ দানে বিরত থেকে গ্রহক হয়রানী করছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, তাদের কোন কোন সময়ের আচার- আচরণ ও কর্মকান্ড পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজনের উপর বর্ণ বৈষম্যের পর্যায়ে পড়ে।
নানান অঘটন পটিয়সি হাটাজারীর উপজেলার বাসিন্দা এই সহকারী প্রকৌশলী অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে চট্টগ্রামের কর্ণেল হাটে বহুতল ভবন নির্মাণ করে সেখানে এক স্ত্রীকে রেখেছেন। অপর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের সম্মুখস্থ জনৈক নৃপতি বসায় ভাড়া থাকেন। এছাড়াও নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংককে তার রয়েছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও প্লট। তিনি কোন কর্মস্থলেই বেশিদিন টিকতে পারেনি। হাটহাজারী থেকে ফোজদাহাট, তারপর সন্ধীপ থেকে বেতবুনিয়া হয়ে বর্তমানে রাঙামাটি। বেতবুনিয়া থাকাকালীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারনে স্থানীয়দের হাতে তিনি হেনস্তা হন। কাউখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ সেখানের প্রশাসনের সর্বস্তরের মানুষ তার উপর চরম ক্ষুব্ধ হওয়ায় তাকে কর্তৃপক্ষ রাঙামাটি অফিসে নিয়ে আসে। সম্পদের দিক থেকে একই অবস্থা নির্বাহী প্রকৌশলীরপ্রতিষ্ঠানটির মূলকাজ বিল আাদায়ে অমনোযোগী হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানোয় বকেয়া পড়ে গেছে কমবেশি ১২ কোটি টাকার বৈদ্যুতিক বিল। এর মধ্যে সরকারি দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭ কোটি টাকা। আর সাধারণ গ্রাহকদের কাছে কমবেশি ৫ কোটি টাকা। এতো বিপুল পরিমাণ টাকা গ্রাহকদের নিকট বকেয়া পড়ে থাকার পরও সেইদিকে নজরই নেই তাদের। শুধু ঘুষ বানিজ্যে বেপরোয়া তারা। তাদের এসব অনিয়ম দূর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি বিষয়ে রোববার ( ২১ মে) জগৎ জ্যোতি চাকমা নিজেরই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কাছে লিখত অভিযোগ দায়ের করেছে।
এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সাইফুর রহমান তার দপ্তরের অনায়াদী বিপুল পরিমাণ বকেয়া থাকার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগে একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয়।
রাঙামাটি বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মৌখিক অভিযোগ পাচ্ছি। আমাকে লিখিত অভিযোগ দিলে, আমি অনিয়ম দূর্নীতি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।