|| মুহাম্মদ ইলিয়াস-১২ এপ্রিল, রাঙামাটি ||
রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে জলে ভোরে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে বুধবার থেকে পাহাড়ে বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে। এ উৎসবকে ঘিরে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলা( রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ) জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা । হ্রদ,পাহাড়, ঝর্ণা আর সবুজ বনের সুন্দর মনের মানুষ গুলো মেতে উঠেছে উৎস আয়োজনে।
প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী এ প্রধান সামাজিক উৎসবের আয়োজন করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন। সংক্ষেপে উৎসবটিকে বৈসাবি হিসেবে মূল্যায়ন করলেও চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও অহমিয়া জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে।
বুধবার থেকে শুক্রবার তিন দিনব্যাপী মূল উৎসব পালন করা হয় পাহাড়িদের ঘরে ঘরে। ১২ এপ্রিল ভোরে পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা, হ্রদ বা নদীর ঘাটে পানিতে ফুল ভাসিয়ে শুরু হবে পাহাড়িদের তিন দিনের ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসবটি। উৎসবটিকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘বৈসুক’, মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমাদের ‘বিজু’ আদ্যাক্ষর মিলিয়ে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ও বলা হয়।
চাকমা সম্প্রদায়ের সামাজিক রীতি অনুযায়ী ২৯ চৈত্র (১২ এপ্রিল) বুধবার ভোরে ফুল বিজুর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নদ-নদী বা হ্রদ ও পাহাড়ি ছড়াগুলোর পানিতে ফুল ভাসানো হয়। ফুল ভাসাতে পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা নতুন জামাকাপড়ে সেজে ওঠে। ফুলে ফুলে সেজে ওঠে চেংগী, মেইনী, কাচালং, কর্ণফুলী আর কাপ্তাই হ্রদসহ পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়াগুলো। ফুলবিজুর দিন মূলত: পুরনো বছরের যত দুঃখ-গ্লানি, ভয়, অন্তরায়, বাধা-বিপত্তি দূর করে নতুন বছরে সুখশান্তি ও সফলতার প্রার্থনায় মহান সৃষ্টিকর্তার স্মরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করে পানিতে এই ফুল ভাসানোর আয়োজন ।
৩০ চৈত্র (১৩ এপ্রিল) বৃহস্পতিবার বিজু উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু হিসেবে পালিত হয়। এ দিনে বাড়িতে বাড়িতে রান্না করা হয় পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাজন (মিশ্র সব্জি) । এর সাথে আগত অতিথিদের জন্য থাকে বিভিন্ন ধরনের খাবার। থাকে পানীয়ও । দ্বিতীয় দিনের ‘মূলবিজুতে পাহাড়ের ঘরে ঘরে আনন্দ- উৎসবের মধ্যে সাধ ও সাধ্যমতো আয়োজন চলে আপ্যায়নের।
পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) শুক্রবার উৎসবের তৃতীয় দিন হচ্ছে গোজ্যেপোজ্যে বিজু বা নববর্ষ উৎসব।সেদিনে বিশ্ব শান্তি ও সর্বজীবের মঙ্গল কামনায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে এবং মন্দিরে পালিত হয় ধর্মীয় নানা আচার- অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় পালিত হয় মঙ্গল প্রদীপ পূজা।
বিজুতে গ্রামের প্রতিটি ঘরেই ফুল সংগ্রহ করে সাজানো হয় বাড়ির আঙিনা। সন্ধ্যায় বৌদ্ধমন্দির, নদীর ঘাটে ও বাড়িতে জ্বালানো হয় প্রদীপ। যুগ যুগ ধরে চলা পাহাড়ের বৃহৎ এই সামাজিক উৎসবটি উদযাপন করে আসছে এখানকার জনগোষ্ঠীরা।
রাঙামাটি গুরুত্বপূর্ণ বিজুর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বুধবার সকালে খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে বিজুর আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। এদিন ভোর থেকেই রাঙামাটি রাজবন বিহার ঘাট,গর্জনতলী,ডিসি বাংলো,কেরানি পাহাড় এলাকা,পলওয়েল, আসামবস্তিসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় নানা বয়সের নারী-পুরুষ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে কলাপাতায় ফুল ভাসান।
এদিকে বুধবার সকালে কেরানি পাহাড় এলাকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আয়োজনে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজুর উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক রনেল চাকমাসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।