• ২১শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৭শে সফর, ১৪৪৭ হিজরি

বন্যায় সুনামগঞ্জের সড়ক গুলো লন্ড ভন্ড,২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত জুন ৩০, ২০২২
বন্যায় সুনামগঞ্জের সড়ক গুলো লন্ড ভন্ড,২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
 লতিফুর  রহমান রাজু,সুনামগঞ্জ: শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কারণে সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সড়ক গুলোর লন্ড ভন্ড অবস্থা। যানবাহন চলাচল তো দুরের কথা মানুষ চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে। জেলার ২২ শ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে টাকার পরিমাণে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা। পানি নামার সাথে সাথেই দ্রুত সড়ক গুলোর নির্মাণ ও সংস্কারের দাবী জানিয়েছেন জেলাবাসী।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল সুনামগঞ্জ। উজানে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এবার ভাটির জেলা সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাত থেকে মাত্র ১২ ঘন্টাতেই পুরো সুনামগঞ্জ জেলা বনার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত গতিতে বন্যা ভয়াবহ রূপ নেওয়াতে সুনামগঞ্জের দু’টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পুরো জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সুনামগঞ্জ পৌরশহর থেকে শুরু করে সীমান্তবর্তী ও দুর্গম গ্রামের অনেকের কাঁচা এবং অর্ধ-কাঁচা ও ইটের তৈরি বাড়িঘরও পানির তোড়ে ভেঙে যায়। গবাদিপশু, হাঁস মুরগিও ভেসে গেছে বানের জলে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার সড়কগুলো। অবস্থা এমন যে,যেন সুনামির ছোবলে সুনামগঞ্জকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে!

ধীরে ধীরে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠেছে সড়ক, মহাসড়ক, অনেক সেতু ও কালভার্ড- গ্রামীণ সড়কের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের সুনামগঞ্জে প্রায় ২ হাজার ২শ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলেও জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও সড়ক ও জনপথ বিভাগ।

সরজমিনে ঘুরে দেখা যায় সিলেট-সুনামগঞ্জের মহাসড়ক, উপজেলা সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে পানির তোড়ে ড্রেনের মতো গহীন হয়েছে। জেলার প্রধান প্রধান সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে বড় বড় আকারে ভেঙ্গে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়েছে। এসব সড়ক যেখানে সম্ভব ইট-পাথর দিয়ে যান চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সড়ক ও জনপথ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে সুনামগঞ্জের নিচু এলাকার অনেক সড়ক এখনও পানির নিচে রয়েছে।

জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে বানের স্রোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দোয়ারাবাজার ও ছাতক, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর, মদনপুর-দিরাই-শাল্লা এলাকায়। এছাড়া সুনামগঞ্জের পৌর শহরের বিভিন্ন সড়কের ও জেলার কয়েকটি উপজেলার সড়ক গুলোর পিচ-খোয়া উঠে বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় অসংখ্য খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হওয়া ছোট-বড় গর্ত এড়িয়ে যানবাহন চলছে এঁকেবেঁকে। এতে যান চলাচল করতে হয় ধীরগতিতে। গর্তে পড়ে ঘটছে দুর্ঘটনাও।

বন্যার ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর-বিশ্বম্ভপুর উপজেলার সড়ক দেখলে মনে হবে শক্তিশালী এক সুনামির ছোবল পড়েছে এসব এলাকায়। গাছ-ঘরবাড়ি যেমন দুমড়েমুচড়ে গেছে, তেমনিভাবে দুমড়েমুচড়ে গেছে বিশ্বম্ভপুর উপজেলার সড়ক। কোথাও কোথাও সড়কের কার্পেটিং ও বেইজিং সরে গিয়ে স্রোতে দুই থেকে দুই থেকে তিন ফুট মাটি সরে গেছে।

বিশ্বম্ভপুর উপজেলার চালবন পয়েন্ট স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মাদ আলাউদ্দিন  বলেন,ঘরবাড়ি পানির নিচে, চারপাশে অথৈই পানিতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও উপায় ছিলো না। এই সড়ক দিয়ে যে উচু কোনো জায়গায় যাবো সেই ব্যবস্থাও ছিলো। এই বন্যায় আমাদের প্রধান সড়ক টা একেবারে ভেঙে ঠুকরা ঠুকরা করে দিছে। এখন এই ভাঙ্গা সড়কে যাতায়ত করার মত উপযোগী রয়েছে না।

তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা সেলিম আহমেদ   বলেন, এমন প্রবল স্রোত আমার বয়সে দেখিনাই। একটা পাকা সড়কের অংশকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তাহলে বুঝতেন যে কত শক্তিশালী ছিলো এই পানির চাপ। আর আমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত ছিলাম এই রাস্তায় মানুষ চলাচল করতে পারে নাই। এই এলাকার মানুষের কষ্ট দুর্দশা আমার জীবনে আর দেখেনি। সরকারের কাছে দাবি দ্রুত যেনো আমাদের সড়ক টা মেরামত করে দেয়।
ছাতক উপজেলার সিএনজি চালক শামীল মিয়া  বলেন, বন্যায় আমাদের সড়ক ভেঙ্গে গেছে, এখন এই সড়কে গাড়ি নিয়ে চলাচল করতে খুবই অসুবিধা হয়। গাড়ি দিয়ে চলাচল
করতে ভয় হয়, ভাঙ্গায় পরে গাড়ি উল্টে পরে যায়। এর মধ্যে আমার দেখা দু-একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। সকালে আমি আমার গাড়ি নিয়ে উল্টে গেছিলাম, আমি গরিব মানুষ নাইর মাঝে আমার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলো। কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই বন্যায় ভেঙ্গে যাওয়া সড়ক গুলো যেন দ্রুত মেরামত করা হয়।

সড়ক ও জনপথ, সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, আমাদের ৮ টি  সড়কের ১৮৪ কিলোমিটার এবং ৩০ টি ব্রীজ  কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  টাকার অংকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ শ কোটি টাকা। তবে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে এখনও পানি নেমে যায় নি। পুরোপুরি পানি নামলে ক্ষয়ক্ষতির আসল চিত্র পাওয়া যাবে। যেসব ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা ভেসে উঠছে ইতোমধ্যে সেগুলোতে ইটের সলিং, বালু ফেলে যানবাহন চলাচলের উপযোগী সড়ক করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম বলেন, বন্যায় পানির স্রোতে জেলার বেশ কয়টি সড়কের মারাত্মকভাবে ভেঙে গেছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্থ স্থান গুলো পরিদর্শন করে আসছি। বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত জেলায় ৭৮৫টি সড়কের ২ হাজার কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১২০টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এসব সড়ক মেরামতে প্রাথমিকভাবে ১৫শ’ কোটি টাকা প্রয়োজন মনে করছি। এখনো জেলার অনেক গ্রামীণ সড়কে বন্যার পানি আছে। তাই ক্ষয়ক্ষতি চূড়ান্ত করা হয়নি।সেগুলো জেগে উঠলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত  বলেন, বন্যায় আমার পৌর এলাকার সমস্ত ভিটুমিনের সড়কগুলোর খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নূতন পুরাতন সড়ক গুলোও ভেঙ্গে গেছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাবো তখন সরকার বরাদ্দ দিলে মেরামত কাজ শুরু করতে পারবো। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা হবে। আমরা ইতিমধ্যেই ৪৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তেরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আপাতত জোরাতালি দিয়ে চালানো ছাড়া অন্য কোন বিকল্প দেখছি না।