• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সুনামগঞ্জে ডুবছে হাওর,কাঁদছে কৃষক

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত এপ্রিল ৮, ২০২২
সুনামগঞ্জে ডুবছে হাওর,কাঁদছে কৃষক

লতিফুর রহমান রাজু, সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ জেলার ছোট বড় প্রায় শতাধিক হাওরের মধ্যে ইতিমধ্যেই ১৫ টিতে সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাধঁ ভেঙ্গে আনুমানিক ৭ হাজার হেক্টর বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর অবশ্য ১২টি বাধঁ ভেঙ্গে ৪৩৫০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।


সময় মতো বাধেঁর কাজ শেষ না করা, অর্থ ছাড় না করা, প্রকৃত কৃষকদের পিআইসির অন্তর্ভুক্ত না করার ফলেই দূর্বল বাধেঁর কাজ হওয়ায় প্রথম ধাক্কা য়  বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে কৃষকদের স্বপ্ন সাধ চুরমার হয়ে গেছে এমন অভিযোগ সুনামগঞ্জ বাসীর।  সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হাওরের ফসল হারিয়ে কৃষকরা বোবা কান্না করছেন।  কারণ তাদের চোখের সামনেই রক্ত ঘামে ফলানো সোনার ফসল পানির নীচে ডুবে গেছে কিন্ত কিছুই করতে পারছে না।

অনেক কৃষক বাধেঁর কাজ করতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন বাধেঁর পাশেই। বাধেঁর কাছাকাছি পানি আসলে বা বাধঁ ভাঙ্গার উপক্রম হলে গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে ঘোষনা দিলে শত শত নারী পুরুষ ও বাচ্চারা উড়া কোদাল বাশঁ সহ বাধঁ রক্ষার জন্য প্রাণপন লড়াই করছে।  গত কদিন হাওরের এমন চিত্রই চোখে পড়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের গ্রাম জয়পুরের কৃষক কপিল নুর বলেন একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে চিন্তার শেষ নেই, বাচ্চা কাচচা নিয়ে কিভাবে বাকী দিন কাটাব খেয়ে পরে বাচবঁ।
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার উত্তর কামলাবাজ গ্রামের কৃষক নুর আলী। তার জমি রয়েছে হালির হাওরে। ৭ কিয়ার জমি চাষাবাদ করেছে এতে উৎপাদন খরছ পড়েছে  ৩০/৩৫ হাজার টাকা। বৌলাই নদীর তীরে চাপড়া তৈরি করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাস করছে কারণ হাওরের গইননা ভাঙ্গা বাধঁ ও শনির হাওরের নান্টু খালির ক্লোজার হুমকির সম্মুখিন ছিল।এখন উপজেলা চেয়ারম্যান   ইউএনও ও কৃষক দের চেষ্টার পর ভালই আছে। বরাম হাওর পাড়ের কৃষক শহীদুল ইসলাম ,সত্যের বাদশা ,আতাউর ও কেরামত আলী জানান বছরে একটি ফসল ঘরে তোলার জন্য আমরা খুব পরিশ্রম করি  অর্থ খরছ করি কিন্ত ধান কাটার আগ মুহুর্তে পাহাড়ি ঢলে সব লন্ড ভন্ড হয়ে যায়।  এ ব্যাপারে সরকার স্থায়ী সমাধান করার ও দাবী জানান।  তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের রাম সিংহ পুর গ্রামের কৃষক আইকুল মিয়া জানান বাঘমারা বাধঁ হুমকির সম্মুখিন ছিল সবার সম্মিলিত সহযোগিতার জন্য এখন ঝুকিঁ মুক্ত ।দিরাই উপজেলার সর মঙ্গল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের কৃষক আং ছাত্তার জানান যখন পানি আয় তখন সবাই দৌড়াদৌড়ি করে এভাবে যদি আগে করত তাহলে আমাদের বিপদ হত না। তিনি আরও বলেন চাপতির হাওরের বৈশাখী বাঁধ ভাঙ্গার ফলে ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে । তাড়ল ও জগদল ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন সাধ ভেঙ্গে গেছে। যাদের কারণে বাধেঁর এই অবস্থা তাদের শাস্তি দাবী করেন। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌড়া রং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফুল মিয়া বলেন পানির প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারে না তাহলে কোটি কোটি টাকা খরছ করে এমন বাধেঁর কি দরকার।
কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে পিআইসি গঠন করার জন্য দুর্বল বাধঁ নির্মাণ হয়েছে। যারা বাধেঁর কাজ করে এরা বাধঁ ব্যবসায়ী। এদের কবল থেকে কৃষকদের বাঁচাতে হবে।   ডুবে যাওয়া দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের কৃষক নুরুল আমিন বলেন ৩০ কিয়ার জমিতে অনেক টাকা খরচ করে ব্যাংক থেকে ঋণ তুলে চাষাবাদ করি কিন্তু ধান কাটার আগেই ফসল তলিয়ে গেছে এখন ব্যাংক লোন কিভাবে পরিশোধ করব আর সংসার কিভাবে চালাব ভেবে পাচ্ছিনা।  ধর্ম পাশা উপজেলার দক্ষিণ বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাসেল আহমদ জানান এমন এক দায়িত্ব ছাড়া লোককে পিআইসির কমিটির সদস্য করা হয়েছে হাওরের ফসল রক্ষার জন্য ফোন দিয়ে ও আনা সম্ভব হয় না। যুব নেতা আসাদুজ্জামান সেন্টু বলেন বাধেঁর কাজ ও সংস্কারের জন্য শুধু কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ দিলে চলবে না নীতিমালা মানতে হবে। বাধের গোড়া থেকে গর্ত করে মাটি তোলা বন্ধ করতে হবে। ৯০ ভাগ বাধেঁর পাশে গর্ত করে মাটি উত্তোলণ করে বাধঁ নির্মাণ করার ফলে বাধঁ দুর্বল হয়ে হুমকির সম্মুখিন হয়। দিরাই উপজেলার বাসিন্দা শাহজাহান চৌধুরীর মতে দিরাই চাতল থেকে কালিয়ার কাপন পর্যন্ত এ বছর বাধেঁর  কাজ না করার ফলে চাপতির হাওরে পানি প্রবেশ করে ফসল হানী ঘটছে। প্রতি বছর এখানে বাধেঁর কাজ হয়। এই হাওরেই ১৮ হাজার কৃষক পরিবারের সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমি আছে।  রাজনীতিবিদ সিরাজুর রহমান সিরাজ বলেন সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের আহসান মারা ব্রীজের পাশের বাধঁ খুব দুর্বল। হুমকির সম্মুখিন থাকায় এলাকার মানুষ কাজ করে বাধঁ রক্ষা করে। আর না হয় বাধঁ ভেঙ্গে দেখার হাওরের শত শত একর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হত।  সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন পিআইসি গঠনে শুরু থেকেই অনিয়ম দুর্নীতির কারণেই বাঁধের কাজ দুর্বল। প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে পছন্দের লোক দিয়ে পিআইসির মাধ্যমেই সরকারের টাকা লোপাট করা হয়েছে।  অধিকাংশ বাঁধ নির্মাণের জন্য বালূ ও কাদা মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। ক্লোজার গুলো ও ঠিক মতো কাজ হয়নি। তাই প্রথম ধাক্কায় বাধেঁর এই সর্বনাশ।
সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২ টি হাওরে ৭২৭টি পিআইসি ১৩৫টি ক্লোজার সহ মোট ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের ও সংস্কারের জন্য সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১২১ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রদান করেন।  বাধেঁর কাজ শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি কিন্ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ না হওয়ার পর আর ও -১০দিন সময় বৃদ্ধি করার পর ও কাজ শেষ হয়নি।  এরই মধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল এসে ফসল রক্ষাবাঁধের সর্বনাশ করে সুনামগঞ্জ বাসী চরম উদ্বিগ্ন করে।