• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের কাজে অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিবাদে রাজপথে মানুষ

bilatbanglanews.com
প্রকাশিত এপ্রিল ৬, ২০২২
হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের কাজে অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিবাদে রাজপথে মানুষ
লতিফুর রহমান রাজু, সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২ টি হাওরের ৭২৭ টি পিআইসি ১৩৫টি ক্লোজার সহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত ও সংস্কারের জন্য সরকার এ বছর ১২১ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রদান করেন। কিন্ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করা হয় না । সময় মতো অর্থ ছাড় করা হয় না এমনকি মনিটরিং ও ঠিক মতো না হওয়ার অভিযোগ কৃষকদের। ফলে পাহিড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কায় সুনামগঞ্জের একমাত্র বোরো ফসল একে একে তলিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে কৃষকদের স্বপ্ন সাধ ভেঙে চুরমার হচ্ছে। সুনামগঞ্জের কৃষককুল এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রের মতে এ বছর জেলায়-২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর বোরো ফসল চাষাবাদ হয়। এতে ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্ত যথাসময়ে হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের কাজ শুরু করা হয়নি। সর্বশেষ কাজ শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি কিন্ত শেষ না হওয়ার কারণে আরও সময় বৃদ্ধি করে ১০ মার্চ করা হলে তাতে ও কাজ হয়নি। কোন কোন হাওরের বেড়িবাঁধ মাটি ভরাট হলে ও ঠিক মতো দুর্মুজ,স্লোব ও ঘাস লাগানোর কাজ করা হয়নি।
এমনকি আজ পর্যন্ত কোন বাঁধেরই শতভাগ  কাজ শেষ হয়নি। এখনোও হাওরের ধান কাঁচা রয়েছে এ মুহুর্তে গত ২ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার বাঁধভেঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওর তলিয়ে যায়, ৪ এপ্রিল তলিয়ে যায় শাল্লা, ছাতক ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কয়েকটি হাওর, ৫ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে ডুবে যায় ধর্মটপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার তাল হাওরটি যেটি ২০১৭ সালে প্রথম ডুবেছিল।
হাওরে শত কোটি টাকার অধিক প্রকল্পে নেই কোন মনিটরিং, নেই কাজের গুণগতমান বজায়ের চেষ্টা। কাজের শুরু থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও দের বিরুদ্ধে। তাদের দুর্নীতির কারণেই বাঁধের কাজের মান ভাল হয়নি। তাই সামান্য বৃষ্টিতেই বাঁধভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। জেলা দোয়ারাবাজার দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নে প্রকল্প বাস্থবায়ন কমিটি (পিআইসি) কিংবা হাওরের কৃষকদের মধ্যে ঘুরেফিরেই আসছে এখন এখলাচুর রহমান ফরাজির নাম। সুরমা ইউনিয়নের ১৯টি পিআইসির মধ্যে ১১টিতে সভাপতি-সেক্রেটারি এখলাছ ফরাজী ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা। এখলাছুর রহমান ফরাজী উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের গিরিশনগর গ্রামের বাসিন্দা।
১৯টি পিআইসির বরাদ্দ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। পিআইসির তালিকায় দেখা গেছে, সুরমা ইউনিয়নের ১ নম্বর পিআইসির সভাপতি এখলাছুর রহমান ফরাজি। তাঁর ভাতিজা আতাউর রহমান ও ভাগনে মাসুদ যথাক্রমে ৩ নম্বরের সভাপতি ও সেক্রেটারি। আত্মীয় শহীদুল ইসলাম ৪ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব। ভাতিজা আব্দুল জলিল ৭ নম্বরের সভাপতি। ভগ্নিপতি মো. রমজান আলী ২৪ নম্বরের সদস্যসচিব। ভাতিজা মোশারফ হোসেন ফরাজী ও ছোট ভাই ইলিয়াস ফরাজী যথাক্রমে ২৮ নম্বর পিআইসির সভাপতি ও সদস্যসচিব। ভাতিজা কলিম উদ্দিন ৪০ নম্বরের সদস্যসচিব। আরেক ভগ্নিপতি রহমত উল্লাহ মানিক ৪১ নম্বর পিআইসির সদস্যসচিব।
শুধু এখলাছুর রহমান ফরাজীর আত্মীয়-স্বজন নয়, ৬ নম্বর পিআইসিতে অসুস্থ দৃষ্টিহীন জয়নাল আবেদিনকে সভাপতি করা হয়েছে। ৩৯ নম্বর পিআইসির সভাপতি করা হয়েছে মঈনুল ইসলাম নামের একজনকে। অথচ সঙ্গে যে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে তা রাজবাড়ী জেলার এক ব্যক্তির। ৪৩ নম্বর পিআইসির সদস্যসচিব করা হয়েছে চান মিয়া নামের একজনকে। অথচ মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে আরেক ব্যক্তির। এভাবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রকল্প বাস্থবায়ন কমিটি গঠনে নয়ছয় করেছে কাবিটা প্রকল্প বাস্থবায়ন ও মনিটরিং কমিটি। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলার, মাটিয়ান হাওর, শনির হাওর, দেখার হাওর, জামখলা হাওর, কাঁচিভাঙ্গা হাওর, সাংহাই হাওর, খাই হাওর, নাইন্দার হাওর, মাচুখালি হাওর, চাওলির হাওর, খরচার হাওর, আঙ্গুর আলী হাওর, হালির হাওর, পুটিয়ার হাওর, চাপতির হাওর, বরাম হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, কালিয়াকোটা হাওর, উৎগল হাওর, নলুয়ার হাওর, সুরাইয়া বিবিআনা হাওর, চায়ার হাওর, ভান্ডাবিল হাওর, ভেড়ারডহর হাওর, মহালিয়া হাওর, পাখনার হাওর,  চন্দ্রসোনারথাল হাওর, রুইবিল হাওর, সাপারিয়া পাথারিয়া হাওর, গুরমা হাওর, কানলার হাওরে কৃষকদেরা সোনার ফসল আজ হুমকির সম্মুখিন। বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় যে কোন সময় হাওরগুলো তলিয়ে গিয়ে কৃষকের সর্বনাশ হতে পারে।
। ৩ এপ্রিল রাত থেকে সাধারণ কৃষকরা তাদের বাঁধের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা নিজেরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরা বাঁধ এলাকায় না থেকে গাঁ ঢাকা দিয়েছেন। যেহেতু এখন পর্যন্ত কোন পিআইসি স্কীম বাস্থবায়ন ও মনিটরিং কমিটির হাতে বাঁধের কাজ শেষ করে হস্তান্তর করেননি সেহেতু বাঁধের কাজ পিআইসি করার কথা। এসবের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ কৃষককুল রাজপথে নেমেছে। বুধবার হাওর বাঁচাও আন্দোলন সুনামগঞ্জের উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মনব বন্ধন কর্মসূচি পালন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারক লিপি দিয়েছেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।  সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি ও  হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের কাজের অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে মানব বন্ধন করে এবং স্মারক লিপি প্রদান করেন।  আগামীতে আরও কঠোর আন্দোলনের ও হুশিয়ারী দিয়েছেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বুধবার দিরাই উপজেলার হুরা মন্দিরা হাওরের ৫৫  নং পিআইসির সদস্য সচিব জগদল ইউনিয়নের বাসিন্দা সামছুল ইসলাম কে  উপস্থিত কৃষকরা মারধর করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। কারণ সে ঠিক মতো কাজ করেনি।
দিরাই উপজেলার জারলিয়া খেয়াঘাটের বাধেঁর উপর দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। শাল্লার ছায়ার হাওরের ৯০ নং পিআইসি ও ঝুঁকিপূর্ণ।  বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করছার হাওরের বিভিন্ন বাধঁ হুমকির সম্মুখিন।  হরিমনের ভাঙ্গা,বেকা বাধঁ  আঙ্গারুলী হাওরের ৯নং পিআইসি দুটিতে বুরুংগা দিয়ে পানি প্রবেশ করছে।ফতেহপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ জানান ১৭ নং পিআইসির কালা গাঙগের ক্লোজার ২২ নং পিআইসির মিছৈর খারা, সামসুল খারা ফাটল দেখা দেয়ায় ইউএনও ও উপজেলার চেয়ারম্যান সহ স্হানীয় কৃষক দের সাথে নিয়ে বাশঁ বস্তা ও জিও টেক্সটাইল দিচ্ছি। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিউর রহিম জাদীদ জানান গত কদিন ধরেই নির্ঘুম রাত কাটছে দিনে রাতে বাধেঁ বাধেঁই সময় কাটছে। এখন পর্যন্ত হাওর টিকে আছে তবে কখন কি হয় বলা মুশকিল।  জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বহী অফিসার বিশ্বজিত দেব জানান বৌলাই নদীর দুই তীরে দুটি বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। একটি হালির হাওর আর,একটি শনির হাওর। এখানে কাকঁড়ার গর্ত দিয়ে পানি প্রবেশ করে চরম সর্বনাশ করছে। এখন পর্যন্ত জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলার চেয়ারম্যান গণ ইউএনও গণ এবং সর্বস্তরের মানুষ মিলে দিন রাত পরিশ্রম করে টিকিয়ে রাখছি। বিশ্বম্ভরপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন অভিযোগ করেন সময় মতো বাধেঁর কাজ হয়নি,বস্তা বাশ ঘাস লাগানো হয়নি তাই এই দুরবসহা।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ পরিচালক বিমল কুমার সোম জানান টাঙ্গুয়ার হাওরের নজর খালি বাধঁ ভাঙ্গার কারণ জানতে আমাকে প্রধান করে যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে তার কাজ চলছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন এ পর্যন্ত যে সব হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের কাজে কোন অনিয়ম দুর্নীতি ও  গাফিলতি থাকলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পিআইসির সদস্য হলে তাৎক্ষণিক মামলা দেয়া হবে। জনপ্রতিনিধি হলে স্হানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে লেখা হবে এবং সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী হলে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জানান হবে।