বিবিএন ডেস্ক: বিভিন্ন ধরনের নৌযানের ক্রেতা থেকে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী প্রতিষ্ঠা পাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘নৌ বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ইতিমধ্যে প্যাট্রল ক্রাফট ও লার্জ প্যাট্রল ক্রাফট নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডে আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ক্রেতা থেকে নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ‘মিডশিপম্যান ২০১৯ আলফা’ এবং ‘ডিইও ২০২১ ব্রাভো’ ব্যাচের শীতকালীন রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রামের বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, গত নভেম্বর ২০২১ জার্মানি থেকে নতুন একটি এমপিএ (মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফ্ট) বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর এভিয়েশন উইংয়ে যুক্ত হয়েছে এবং অপরটি আগামী ২০২২ সালের মে মাসে যুক্ত হবে। হেলিকপ্টার এবং এমপিএ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আধুনিক সকল সুবিধা সম্বলিত দ্বিতীয় হ্যাঙ্গারের নির্মাণ কাজও চলমান রয়েছে।
নৌ বাহিনীর সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভবিষ্যতে আরও অধিক উন্নত জাহাজ এবং আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাবমেরিন ও যুদ্ধ জাহাজগুলোকে পোতাশ্রয়ে নিরাপদ জেটি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে কক্সবাজারের পেকুয়াতে আধুনিক বেসিন সুবিধা সম্বলিত স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উপকূলবর্তী এলাকায় নৌ বাহিনীর জাহাজসমূহের অপারেশানাল ও যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ‘শের-ই-বাংলা ঘাঁটি’র নির্মাণ কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থ- সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সমুদ্রসম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঐতিহাসিক ৬ দফায় নৌ বাহিনী সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে নৌ বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস এন্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন যা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্র নীতির ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা সুনির্দিষ্টকরণ সম্ভব হয়েছে এবং ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বিশাল সমুদ্র এলাকায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নৌ বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরে নৌ বাহিনীর জন্য আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজনের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে চাই যে, ২০১৭ সালে নৌ বহরে ‘বানৌজা নবযাত্রা’ এবং ‘বানৌজা জয়যাত্রা’ নামক দুটি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে একটি সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক নৌ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ আমাদের বিশাল সমুদ্রের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি মানব পাচার ও চোরাচালান রোধ, জেলেদের নিরাপত্তা বিধান, বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতকরণে নৌ বাহিনী আরও বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।
সরকার প্রধান বলেন, নতুন নতুন জাহাজ এবং সমরাস্ত্র সংযোজনের পাশাপাশি এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো বৃদ্ধি এবং সময়োপযোগী করার ক্ষেত্রেও আমাদের সরকার কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নৌ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা’র পদনাম পরিবর্তন করে ‘কমান্ডার ঢাকা নৌ অঞ্চল’ করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে পদবি কমডোর থেকে রিয়ার এডমিরালে উন্নীত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমাদের সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুগোপযোগী একাডেমি প্রতিষ্ঠা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ উদ্বোধন করা হয়ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আজ শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, দক্ষ এবং পেশাদার বাহিনী হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ সকলক্ষেত্রে তাদের আত্মত্যাগ ও কর্তব্যনিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরল সম্মান ও মর্যাদা, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে।
তরুণ নৌ কর্মকর্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে চলমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তোমরা তোমাদের অদম্য আগ্রহ, দৃঢ় মনোবল ও সাহসী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছ। আমি আশা করি, চাকরি বা ব্যক্তিগত জীবনের যে কোন সংকটে তোমরা এ ধরনের সুবিবেচনা ও নেতৃত্বসুলভ গুণাবলীর পরিচয় দেবে।
তিনি বলেন, কর্মজীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে তোমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তোমাদের মনে রাখতে হবে, যে কঠোর প্রশিক্ষণ তোমরা শেষ করলে তা তোমাদের উৎকর্ষ অর্জনের সূচনা মাত্র। সততা, সঠিক নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের প্রয়োজনে তোমাদের সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। আমি আশা করবো তোমাদের দেশপ্রেম, শৃঙ্খলাবোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা তোমাদের অধিনস্তদেরও একইভাবে দেশের প্রয়োজনে আত্মনিবেদনে অনুপ্রাণিত করবে।