আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মোল্লা আবদুল গণি বারাদার। কাতার থেকে নির্বাসিত জীবনের সমাপ্তি টেনে মঙ্গলবার আফগানিস্তানে ফিরেছেন তালেবানের এই সহ-প্রতিষ্ঠাতা। দেশে ফেরার পর তাকে দেয়া হয়েছে এক বীরোচিত সংবর্ধনা। কান্দাহারের সড়কে তার গাড়িবহর অতিক্রম করার সময় আশেপাশে তালেবান সদস্যরা তাকে অভিবাদন জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত তাকে আফগানিস্তানের পরবর্তী শাসক হিসেবে মনে করা হচ্ছে। তালেবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর মারা যাওয়ার আগে তার যে কয়েকজন কমান্ডার সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত ছিলেন তার মধ্যে মোল্লা বারাদার অন্যতম। তালেবানের মতো একটি উগ্রবাদী সংগঠনের প্রতিনিধি হয়েও বিশ্বমঞ্চে নিজের কেরামতিটা ঠিকঠাকই দেখিয়েছেন তিনি। কাবুলের ক্ষমতা দখলের পেছনের আসল মাস্টারমাইন্ড হিসেবেও তিনিই স্বীকৃত।
যদিও এই মোল্লা বারাদার তালেবানের প্রধান নন এবং কখনোই ছিলেন না। তাকে মূলত যুক্তরাষ্ট্রই উঠিয়ে এনেছে তালেবানের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর জন্য। অন্য তালেবান নেতাদের মতো তিনি পাকিস্তানপন্থি নন এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কথা তিনি প্রায়ই মেনে চলতেন না। প্রথম থেকেই অসংখ্য তালেবান নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসলেও, মোল্লা বারাদারকে ২০১০ সালে আটক করে পাকিস্তান। এরপরে পাকিস্তানের জেলেই তিনি ছিলেন দীর্ঘ ৮ বছর। অবশেষে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান। এরপর তাকে নিয়ে আসা হয় কাতারে এবং তিনি হয়ে ওঠেন তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান। সেখানে তার সঙ্গে পশ্চিমারা সমঝোতার চেষ্টা করেন। সমঝোতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পশ্চিমা সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে যায়। আর সেই প্রেক্ষিতেই আজ আফগানিস্তানের নতুন প্রধান হতে যাচ্ছেন বারাদার।
তালেবানের কাছে তিনি জনপ্রিয় মোল্লা বারাদার আখুন্দ নামে। পার্সি শব্দ বারাদার ইংরেজিতে হয়েছে ‘ব্রাদার’ যার অর্থ ভাই। ‘আখুন্দ’ শব্দটিও পার্সি। ‘আখুন্দ’ উপাধি দিয়ে সাধারণত পণ্ডিতদেরই কথাই বোঝানো হয়। বারাদারের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সরকারি প্রমাণপত্র পাওয়া যায় না। তবে তার কৌশলের দক্ষতা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় স্বীকৃত। তিনি তালেবানের সর্বময় কর্তা বা প্রধান নেতা নন। কোনোদিনই ছিলেন না। সেই পদে আপাতত রয়েছেন হাইবাতুল্লা আখুন্দজাদা। বরাবর দ্বিতীয় স্থানে কাজ করা বারাদারের ভূমিকা ছিল তালেবান কৌঁশলীর। তিনি সম্মুখেও ছিলেন না কখনো। তবে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তালেবানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
এই তালেবান নেতার জন্ম ১৯৬৮ সালে। আফগানিস্তানের কান্দাহারের একটি দুররানি পশতুন বংশে জন্ম তার। এই দুররানিরা আফগানিস্তানের আদি গোষ্ঠী। তাদের পূর্বপুরুষ আহমেদ শাহ দুররানি আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। বারাদারের ছোটবেলার পড়াশুনা নিয়ে কিছু জানা যায় না। তবে কৈশরেই তিনি সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তখনই মুজাহিদিন হিসেবে পরিচয় লাভ করেন তিনি। যুদ্ধ করেছেন জঙ্গি নেতা মুহাম্মদ ওমরের সঙ্গে। এই ওমরই তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা। ওমরের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনও রয়েছে বারাদারের। ওমরের বোনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি ছিলেন কার্যত ওমরের ডান হাত। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে বড় সফলতাও পায় তারা। ১৯৯৬ সালে তালেবানি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় আফগানিস্তানে। কিন্তু তাদের বর্বর শাসনের কারণে মুখ ফিরিয়ে নেয় পুরো বিশ্ব। সেই সরকারের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন বারাদার।
তালেবানের ৫ বছরের শাসনামলে আফগানিস্তান পরিণত হয় সন্ত্রাসবাদের এক গভীর নরকে। সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেয় তালেবানের আশ্রয়ে থাকা জিহাদিরা। অবশেষে ২০০১ সালের অক্টোবরে তালেবানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হয় সন্ত্রাসবাদে অতিষ্ট পশ্চিমা শক্তিগুলো। মাত্র এক মাসেই ক্ষমতা ছেড়ে পালায় তালেবান। ন্যাটোর হামলায় মারা পড়তে থাকে তালেবানের প্রধান নেতারা। ওই সময়েই কোনোমতে জান হাতে নিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয় কয়েকজন তালেবান নেতা, যার মধ্যে অন্যতম ছিল এই বারাদার। যদিও তিনি পাকিস্তানের কথা শুনতে পছন্দ করতেন না। এদিকে সন্ত্রাসী নেতাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়ার কারণে পাকিস্তানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে বারাদারকে সন্ত্রাসবাদের দায়ে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান পুলিশ। তাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ ৮ বছর পাকিস্তানের জেলেই ছিলেন তিনি।
কাবুল দখলের পর অনেকের মনেই এই প্রশ্ন উঠেছে যে কেমন মানুষ এই মোল্লা বারাদার। আবার ক্ষমতা হাতে পেলে কীভাবে তিনি আফগানিস্তান চালাবেন? বিশ্লেষকরা বারাদারকে কঠিন মানুষ হিসেবেই মনে করেন। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বহুদিন, তবে তিনি একটুও ভাঙেননি। অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ। তিনি কিশোর বয়স থেকে যুদ্ধ করে আসছেন। প্রথমে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে, তারপর সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগান গৃহযুদ্ধেও লড়েছেন তিনি। ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে তালেবানের উৎখাতের পর পাকিস্তানে এলেও মার্কিনিদের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এরপরেও তাকে ঠাণ্ডা মাথার একজন কূটনীতিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি কাতারে বসে নানা দেশের সরকারের সঙ্গে আপস মীমাংসা করেছেন, বিদেশ সফর করেছেন।
২০১৮ সালের অক্টোবরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তখন এমন খবর বেড়িয়েছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার মুক্তি চেয়েছিলেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ করার জন্য তালেবানের সঙ্গে মীমাংসায় বসার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে লক্ষ্যে ওই সংগঠনের একজন সুবিধাজনক নেতার খোঁজ করছিলেন। এই খবর সত্য প্রমাণিত হয় যখন মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরই বারাদার দোহায় গিয়ে তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের দায়িত্ব নেন। পশ্চিমা কূটনীতিকরা দেখেছিলেন যে তালেবান শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বারাদারই পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কথা সবসময় শুনতে চাইতেন না এবং তিনি অতীতে কাবুলের প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছেন। এরপর ঘটনা দ্রুত আগাতে থাকে। ২০১৯ সালে দোহায় গিয়ে তালেবানের পক্ষে আলোচনায় নেতৃত্ব নেন বারাদার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিও করেন তিনি।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তালেবানের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মোল্লাহ বারাদারকেই সারা বিশ্বের লোকজন দেখেছে। সব মিলিয়ে বারাদার তালেবানের এক নম্বর নেতা নন, কিন্তু বিশ্বের কাছে তিনিই এখন তালেবানের মুখ হিসাবে পরিচিত। তিনি ভালো ইংরেজিও জানেন। বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। বিদেশ সফরে গিয়ে তিনি সবাইকে ভরসা দিয়েছেন যে নমনীয় ইসলামের ভিত্তিতে আফগানিস্তান পরিচালিত হবে। তিনি স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা বোঝেন। তালেবানের বেশিরভাগ নেতাদের মতো তিনি বর্বর চিন্তা করেন না এমন ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন বারাদার। কাশ্মীর ইস্যুতে বলেছেন, এটি তালেবানের দেখার বিষয় নয়। এটি তার তুখড় বুদ্ধির প্রমাণ দেয়। বারাদার চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। চীনকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, উইঘুর সন্ত্রাসীদের আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেবেন না তিনি। এছাড়া সমগ্র বিশ্বকে তিনি বারবার বলেছেন, নতুন তালেবানের অধীনে আফগান ভূখণ্ডকে কোনো জিহাদি সংগঠনকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আল-কায়দা ও ইসলামিক স্টেটের মতো সংগঠনগুলোকে দমানোর কথা বলেছেন তিনি। সব মিলিয়ে তিনি তালেবানকে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও অনেকেই বিশ্বাস করেন, আসলেই তালেবান পূর্বের তুলনায় মধ্যপন্থি আদর্শে বিশ্বাস করে এখন।
যুক্তরাষ্ট্রকে বারাদার আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আফগানিস্তানের ক্ষমতা নানা পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি করা হবে। কাবুল দখলের পর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার চাপ তৈরি হয়েছে তাদের ওপর। এমনকি তালেবানের সবচেয়ে বড় সমর্থক পাকিস্তানও সতর্ক করছে যে তারাও কাবুলে বিভিন্ন আফগান পক্ষের সমন্বয়ে একটি সরকার দেখতে চায়। সোমবার আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু তাজিক, উজবেক এবং হাজারা সম্প্রদায়ের নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদে গিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলেছেন। পাকিস্তান আরও জানিয়েছে, আগের বারেরমতো পাকিস্তান তালেবানকে একতরফা স্বীকৃতি দেবে না। রাশিয়াও বলেছে যে আফগানিস্তানের শাসক হিসাবে তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে তারা তাড়াহুড়ো করবে না। অর্থাৎ যেসব প্রতিবেশী দেশের স্বীকৃতি তালেবানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তারাও চাইছে তালেবানকে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হবে।
তারপরেও ধারণা করা হচ্ছে, কাবুলে যে সরকার হবে তা মূলত তালেবানের সরকারই হবে। সরকারে থাকবে তালেবান এবং তাদের সমর্থকরা। তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও তাদের নীতি-আদর্শ যারা সমর্থন করে তাদেরই সরকারে জায়গা হতে পারে। তালেবান সবসময় আনুগত্যকে পুরস্কৃত করে। যারা ২০ বছর ধরে তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছে, কারাভোগ করেছে, তারাই প্রধান পদগুলো পাবেন। বারাদারের অধীনে নারীদের শিক্ষা এবং কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে না এমন আশ্বাস পাওয়া গেছে। এমনকি একটি টিভি চ্যানেলে মঙ্গলবার তালেবানের একজন নেতা একজন নারী উপস্থাপককে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। এখনো বোঝা যাচ্ছে না, মোল্লা বারাদার এবং তার তালেবান সহযোদ্ধারা যেসব ভরসা-প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তার পেছনে কতটা সততা রয়েছে।
সরকারের প্রধান হয়ে বারাদার যে দেশের নেতৃত্ব দেবেন তার নাম হবে ‘ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তান’। বারাদার এই দেশের স্বপ্ন দেখছেন সেই ১৯৯২ সাল থেকেই। আফগানিস্তানে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেই সময়েই তিনি গড়েছিলেন একটি মাদ্রাসা। উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের আদর্শ ছড়িয়ে দেয়া এবং আফগানিস্তানকে ইসলামিক এমিরেটস হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। সেই স্বপ্ন আজ বহু বাধা পার হয়ে সত্যি হয়েছে। বারাদার হয়তো চাইবেন না আবারো কোনো ভুলের কারণে এটি ধ্বংস হয়ে যাক। তার বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। স্বপ্নের ইসলামিক এমিরেটসকে টিকিয়ে রাখতে হলে যে আপস করতে হবে এই বাস্তবতা হয়তো বারাদার বুঝতে পারছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি কোন পথে হাঁটবেন তা বুঝতে বিশ্বকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।