বিবিএন স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিটি বিশ্বকাপ ঘিরেই কম বেশি কিছু বিতর্ক থাকে ৷ কিন্তু ১৯৭৮ সালে সেই বিতর্ক যেন অন্যমাত্রা পেয়েছিল৷ ফিফার নিয়ম বিধি থেকে আয়োজক তথা বিজয়ী আর্জেন্তিনার ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে৷ সেই বিশ্বকাপের গোটা টুর্নামেন্টের একটি খেলাতেও পরাজিত হয়নি ব্রাজিল তবুও চ্যাম্পিয়ন না হয়ে তৃতীয় হতে হয় যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক বিরল নজির। সেমিফাইনালহীন সেই বিশ্বকাপের শুরুতেই চ্যাম্পিয়ন তথা আয়োজক আর্জেন্তিনা হোঁচট খেয়েছিল ইতালির কাছে হেরে৷ তারপরেও অনেক ঘটনা ঘটেছিল যা ঘিরে বার বার প্রশ্ন উঠেছে৷
সাধারণত বিশ্বকাপ হওয়ার অন্তত বছর চার-পাঁচ বছর আগেই ঠিক হয়ে যায় আয়োজক দেশ কোনটি। সেই মতো ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ঠিক হয়েছিল আর্জেন্তিনা৷ এদিকে আবার ১৯৭৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয় লাতিন অ্যমেরিকার এই দেশে৷ তার জেরে সেখানে ক্ষমতায় আসে ভিদেলের জান্তা সরকার। এই সরকারের কাজকর্ম নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে৷ এই সরকার দেশ চালানোর নামে হত্যা, গুম সহ নানা অত্যাচার চালিয়েছিল এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ব্যাপকহারে গুম করে দিয়েছিল বলে শোনা যেত৷ সরকারের ওই অত্যাচার ও অভাবের ফলে জনগণের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। তখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে ও জনগণের দৃষ্টি ঘোরানোটা ভিদেলের সরকারের খুবই দরকার পড়েছিল। ফলে তিনি তখন এই ফুটবল বিশ্বকাপটিকে তার ক্ষমতায় ধরে থাকার একটা উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন। গোটা দেশে খেলার মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জনমানসের মধ্যে৷ দেশপ্রেম জাগাতে রাস্তায় রাস্তায় ফ্রিতে আর্জেন্তিনার পতাকা বিলোন হয়। আর্জেন্তিনার মানুষও তখন সব অত্যাচার অভাব পীড়ন ভুলে গিয়ে ফুটবলে বিভোর হয়ে পড়ে। ভিদেলার সামরিক জান্তা আর্জেন্তিনার জনগণকে বিশ্বকাপ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হবার উৎসবে মাতানোর জন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সেদিন ফুটবলকে কলঙ্কিত করেন। যেন তেন প্রকারেন আর্জেন্তিনাকে চ্যাম্পিয়ন করতে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলেই অভিযোগ ওঠে৷
এদিকে আয়োজক দেশ আর্জেন্তিনায় এমন জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসায় হল্যান্ডের নেতৃত্বে বেশ কিছু দেশ বিশ্বকাপ অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলে৷ তবে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এভাবে বিশ্বকাপ সরিয়ে নেওয়া তো অত সহজ নয় ফলে আর্জেন্তিনাতেই শুরু হয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের লড়াই। শেষমেশ মোটের উপর সব দল আসলেও বিশ্বকাপ বয়কট করেছিলেন ডাচ কিংবদন্তী ফুটবলার জোহান ক্রুয়েফ ও জার্মান তারকা ডিফেন্ডার পল ব্রিটনার। প্রকাশ্যে না আসার কারণ হিসেবে পারিবারিক বিষয়কে খাড়া করলেও ঘনিষ্ঠমহলে ক্রুয়েফের ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েচিলেন জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এটাই তাঁর প্রতিবাদ। মনে রাখার বিষয় হল ক্রুয়েফ কেবলমাত্র একজন ফুটবলারই নন, বিভিন্ন সময়ে নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁকে সমর্থন দেখাতে দেখা গিয়েছে।
অদ্ভূত এক ফরম্যাটে সেবারে বিশ্বকাপের খেলার সূচি তৈরি করা হয়েছিল যেখানে সেমিফাইনাল বলে কিছু ছিল না। ঠিক হয়েছিল মূল পর্যায়ে অংশ নেওয়া ১৬টি দলের থেকে চারটি দল নিয়ে একএকটা গ্রুপ গড়ার৷ জিতলে দুই পয়েন্ট এবং ড্র করলে এক পয়েন্ট ধার্য করা হয়৷ একই পয়েন্টের অধিকারি একাধিক দল হলে তখন গোল করার ভিত্তিতে গ্রুপ তালিকায় উপরে রাখা হবে৷ গ্রুপের প্রথম দুটি দল পরের রাউন্ডে যাবে৷ ফলে পরের রাউন্ডে ওঠা আটটি দলকে আবার চারটি চারটি করে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়৷ সেখানে কোনও নক আউট পদ্ধতি ছিল না। দলগুলি দু’টো গ্রুপে ভাগ হয়ে রাউন্ড রবিন লিগ ফরম্যাটে পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হতো। ঠিক হয়েছিল এ দুই গ্রুপ থেকে শীর্ষ দু’টি দল সরাসরি ফাইনালে চলে যাবে এবং গ্রুপ দুটিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা দল দুটি খেলবে তৃতীয় স্থান অধিকারের জন্য৷
অবশেষে শুরু হয় বিশ্বকাপ ৷ আয়োজক আর্জেন্তিনা একেবারে প্রথম রাউন্ডেই হেরে গিয়েছিল ইতালির কাছে ৷ তবে শেষ মেশ পরের রাউন্ডে যেতে সক্ষম হয় প্যাসারেলার কেম্পপেজ লুকের দল৷ দ্বিতীয় রাউন্ডের একই গ্রুপে ছিল ব্রাজিল এবং আর্জেটিনা ৷ ওই গ্রুপে শেষ ম্যাচের আগে দুটি দলেরই ঝুলিতে ছিল তিন পয়েন্ট৷ বাকি ছিল আর্জেন্তিনার সঙ্গে পেরুর এবং ব্রাজিলের সঙ্গে পোল্যান্ডের খেলা৷ এরপর ব্রাজিল পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারানোর পরে সমীকরণটা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে ফাইনালে যেতে হলে আর্জেন্তিনাকে তখন অন্তত পাঁচ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে ৷ তা একপ্রকার অসম্ভব৷ কারণ পেরু তখন লাতিন অ্যামেরিকার অন্যতম শক্তিশালী দল৷ ফলে পোল্যান্ডকে হারানোয় অনেকেই ধরে নিয়েছিল ফের ব্রাজিল ফাইনালে যাচ্ছে৷ অথচ বাস্তবে তা হল না কারণ পেরুকে ৬-০ গোলে হারিয়ে এক অঘটন ঘটিয়ে দিয়েছিল আর্জেন্তিনা৷
কিন্তু বড় ব্যধানের এই জয় নিয়েই বিতর্ক ওঠে ৷ শোনা যায় আর্জেন্তিনার জেনারেল ভিদেলার সামরিক সরকার এবং পেরুর জেনারেল ফ্রান্সিসকো বার্মুদেজ এর সামরিক সরকারের মধ্যে ফুটবল খেলার জয়-পরাজয়ের ব্যবধানের নিয়ে নাকি গোপন চুক্তি হয়েছিল৷ তারই সুবাদেই পেরু আর্জেন্তিনার কাছে ৬ গোল হজম করে নেয়। এমনকি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দাবি করেছিল, সে সময় পেরুর প্রয়োজনীয় গমের এক বিশাল অংশের যোগানদাতা ছিল আর্জেন্তিনা। আর সেই গম নিয়ে দরকষাকষি করতেই পেরু সরকারকে চাপ দিয়েছিল নাকি আর্জেন্তাইন জান্তা সরকার। তাছাড়া গুজব ছড়ায় আর্জেন্তিনার জেলে বন্দী ১৩ জন পেরুভিয়ান নাগরিককে মুক্তি দেবার বদলে এই জয়টি চেয়ে নিয়েছিল জান্তা সরকার। গুজব হলেও অনেকে তা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছিল না৷ কারণ, বিশ্বকাপ ঘিরে ততদিনে আরও নানা রকম ছোটছোট অভিযোগ জমা হয়েছিল। এমনকি এক পেরুভিয়ান সিনেটর দাবি করেছিলেন, ওই ম্যাচটি নাকি আসলেই পাতানো ছিল!
এরফলে ব্রাজিলের সমান পয়েন্ট থাকা সত্ত্বেও আর্জেন্তিনা উঠে যায় ফাইনালে। আর তৃতীয় স্থানের ব্রাজিল মুখোমুখি হল ইতালির এবং সেই ম্যাচে জিতে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান পেল ব্রাজিল। ফাইনালে হল্যান্ডের মুখোমুখি হল আর্জেন্তিনা৷ কিন্তু দেশাত্মবোধ জাগিয়ে প্রিয় দলের জয় নিশ্চিত করতে খেলার আগের রাতে হল্যান্ডের খেলোয়াড়রা যে হোটেলে ছিল তার সামনে সারারাত ধরে বিপুল শব্দে চালানো হয় কন্সার্ট। উদ্দেশ্য ছিল হল্যান্ডের খেলোয়াড়দের নানা ভাবে বিরক্ত করা এবং ঘুমোতে না দেওয়া । শুধু তাই নয় খেলার দিন হল্যান্ড দলকে স্টেডিয়ামে আনা হয় অনেক বেশী পথ ঘুরিয়ে। তার অনেক আগে কিন্তু পৌঁছে গিয়েছিল আর্জেন্তিনা দল৷ অনেকের মতে ওইবারের মতো কোনও জয়ী দলের প্রতিনিধিদের পরবর্তীকালে অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি৷ তাই তো ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের হয়ে চারটি গোলদাতা তারকা ফুটবলার লুকেও বহু বছর বাদে জানিয়েছিলেন, ‘যা জেনেছি তাতে এখন আর বলা যায় না সেই জয়ের জন্য গর্বিত৷’ তবে দাবি করেছেন, সেই সময়ে সব কিছু বুঝতে পারেননি তখন ফুটবলটাই খেলার মতো করে শুধু খেলেছেন ৷ কারও বা মনে হয়েছে তাদের পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেই সময়৷
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সূত্র: Kolkata24×7.com