বিবিএন নিউজ: পাট থেকে এই প্রথম নতুন এক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান। তিনি এই আবিষ্কারের গল্প বলেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ককে।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পাট নিয়ে গবেষণা করছি। পাটের জীবনরহস্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এর বিভিন্ন অংশে নানা ধরনের অণুজীবের সন্ধান পেয়েছি। দেখলাম, সেখানে উদ্ভিদের ডিএনএ তো আছেই, সঙ্গে অণুজীবের ডিএনএও আছে। প্রথম দিকে ভেবেছি হয়তো ল্যাবে ছেলে-মেয়েরা পাটের ডিএনএ বের করতে গিয়ে অণুজীবের ডিএনএ মিশিয়ে ফেলেছে। পরে এ নিয়ে বিশদ পড়াশোনা করলাম। আসলে আমিই ভুল ছিলাম। যেকোনো জীবের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে বাস করে অনেক অণুজীব। অনুসন্ধানে দেখলাম, গাছের যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা আমরা জানি, আসলে সেগুলো অণুজীবের গুণাবলি থেকেও কিছু কিছু আসে। এসব অণুজীবের প্রকার আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী হতে পারে তা জানার আগ্রহ থেকেই নতুন গবেষণায় মনোযোগী হলাম। এগুলো চিহ্নিত করে শ্রেণিবিন্যাস করতে চাইলাম। পরে আমার সঙ্গে যুক্ত হলেন সহকর্মী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম। অণুজীব নিয়ে কাজ করার অনেক অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।
তখনো জানতাম না:
মোটাদাগে এই কর্মযজ্ঞের শুরু হয় ২০১৪ সালে। ইউজিসির হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রজেক্টের (HEQEP) অধীনে। এই প্রকল্পে আমাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল পাটের মধ্যে যেসব অণুজীব বাস করে সেগুলো চিহ্নিত করে শ্রেণিবিন্যাস করা। শুরুর দিকে পাটের বীজ, পাতা, শিকড়, বাকলের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের উপস্থিতি দেখতে পাই। সেই অণুজীবগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়েই প্রায় ৫০টির বেশি ব্যাকটেরিয়া এবং ৩৫টির মতো ছত্রাকের সন্ধান পেলাম। যেগুলোকে আমরা এন্ডোফাইট বলি। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি, ইমিউনিটি রক্ষাসহ উদ্ভিদকে তারা নানাভাবে সাহায্য করে। অণুজীবগুলো আবার উদ্ভিদ থেকে রসদও সংগ্রহ করে। মানে পরস্পরের মধ্যে একটা মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরে এগুলোকে আমরা আলাদা করলাম। নানাভাবে বিশ্লেষণ করলাম। পৃথিবীজুড়েই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এখন একটা বড় সমস্যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। আমাদের একটা আগ্রহ ছিল, এই অণুজীবগুলোর মধ্যে থেকে নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় কি না দেখা। সেই সঙ্গে এটা কোনো এনজাইম তৈরি করে কি না, ক্যান্সার প্রতিরোধী কোনো যৌগ আছে কি না ইত্যাদিও দেখতে চাইলাম। কাজ করতে গিয়েই দেখলাম, পাটের মধ্যে বসবাসকারী অনেক ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল কম্পাউন্ড তৈরি করে। কিন্তু এর মধ্যে কোনটা যে ইউনিক (অনন্য) তখনো জানতাম না।
নতুন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান:
পরে এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কম্পাউন্ডগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নতুন একটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেলাম। নাম স্টেফাইলোকক্কাস হোমিনিস (Staphylococcus hominis MBL-AB63)। এটা ২০১৫ সালের মাঝামাঝির ঘটনা। আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য এই ব্যাকটেরিয়ার জীবনরহস্য উন্মোচনের উদ্যোগ নিলাম। আইসিডিডিআরবির মলিকিউলার জেনেটিকস ল্যাবে হলো কাজটা। জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখলাম, এই স্টেফাইলোকক্কাস হোমিনিস তার জিনোমের মধ্যে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির সব তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছে। মানে নিজ শরীর থেকে তারা অ্যান্টিবায়োটিকটি তৈরি করে, যা দিয়ে অন্য ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। এটি আমাদের আগ্রহী করে তোলে।
কী আছে সেই ব্যাকটেরিয়ায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের সাহায্য করলেন জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আফতাব উদ্দিন। এ ধরনের কম্পাউন্ড পিউরিফিকেশনের (বিশুদ্ধকরণ) ক্ষেত্রে তিনি বেশ অভিজ্ঞ। এটা কিভাবে অন্য ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে, কোন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে এবং এর গঠন কতটা শক্তিশালী সেটা বোঝার জন্য পিউরিফিকেশন জরুরি ছিল। অধ্যাপক ড. আফতাব উদ্দিন অ্যান্টিবায়োটিক কম্পাউন্ডটি বিশুদ্ধকরণ এবং অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখার কাজে যথেষ্ট শ্রম দিয়েছেন। জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগে তাঁর নিজস্ব ল্যাব ছাড়াও প্রাণরসায়ন বিভাগের ল্যাব এবং বিসিএসআইআর ল্যাবে তিনি দিন-রাত গবেষণা করে গেছেন। এটা আসলে দীর্ঘ যাত্রা। অ্যান্টিবায়োটিককে আলাদা করা মানে পিউরিফিকেশন করা খুবই দুরূহ একটা কাজ। অধ্যাপক আফতাব অসাধ্য সাধন করেছেন।
নতুন অ্যান্টিবায়োটিক:
পিউরিফাই করতে প্রায় বছর দুয়েকের মতো লাগল। পিউরিফাইয়ের পর নতুন এক অ্যান্টিবায়োটিকের খোঁজ পেলাম, যা বাঁচিয়ে দিতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স হওয়া অনেক রোগীকে। নতুন এই অ্যান্টিবায়োটিকের নাম ‘হোমিকরসিন’। ব্যাকটেরিয়া (Staphylococcus hominis) এবং পাটের (Corchorus olitorius) জাত উেসর কথা বিবেচনা করেই এমন নাম দিয়েছি। এর পাঁচটা ধরন আছে। আপাতত দুটি ধরন Homicorcin এবং এর একটি ভিন্ন রূপ ‘Homicorcin-1’-এর বিশুদ্ধকরণ, অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে তাদের কার্যকারিতা দেখা, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে এদের তুলনামূলক চিত্র, নতুন এই অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রিয়া কৌশল জানা এবং কেন এরা উচ্চতাপ কিংবা উচ্চমাত্রার অম্ল বা ক্ষারেও সক্রিয় থাকে—তা দেখা হয়েছে। আমাদের আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিকের গঠন বেশ শক্তিশালী।
ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স নিয়ে সারা পৃথিবীর উদ্বেগ—MRSA (মেটিসিলিন রেজিস্ট্যান্স স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস) ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও এটা ভালো কাজ করছে। এটি গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
অ্যান্টিবায়োটিকটির গঠন জানতে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কাজুহিসা সেইকিমিজু এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অ্যাবারডিনের অধ্যাপক ড. মার্সেল জাসপারস যথেষ্ট সাহায্য করছেন। অধ্যাপক সেইকিমিজু ইনফেকশন মডেলের মধ্যে হোমিকরসিনের কার্যকারিতা এবং NMR-এর মাধ্যমে এই কম্পাউন্ডের গঠন বুঝতে সাহায্য করছেন। অধ্যাপক মার্সেল তাঁর ল্যাবে এই অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক গঠন বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করছেন।
এবার জার্নালে:
এক পর্যায়ে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাপত্র লিখলাম। সেটা বিশ্বখ্যাত নেচার পাবলিশিং গ্রুপের জার্নাল ‘সায়েন্টিক রিপোর্টসে’ সাবমিট করেছি ফেব্রুয়ারিতে। রিভিউ শেষে এটা প্রকাশিত হয়েছে ২৭ মে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম A plant endophyte Staphylococcus hominis strain MBL_AB63 produces a novel lantibiotic, homicorcin and a position one variant.
এই গবেষণাকাজে আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থী শাম্মী আক্তার, মাহবুবা ফেরদৌস, বদরুল হায়দার চৌধুরী ও আল আমিন সহযোগিতা করেছে। সহযোগিতা পেয়েছি বিসিএসআইআরের কাছ থেকেও।
৬৬ বছর পর:
জানা মতে, আমাদের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহম্মদ রমনা পার্কের মাটি থেকে স্ট্রেপটোমায়সিস ব্যাকটেরিয়া পান। সেই ব্যাকটেরিয়া থেকে ‘রমনাসিন’ নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। এসংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে। শিরোনাম ‘Ramnacin : a New Antibiotic from a Streptomyces sp’। যদিও এ নিয়ে পরে আর বেশি কাজ হয়নি। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে ৬৬ বছর পর ‘হোমিকরসিন’ আবিষ্কার করলাম আমরা।
এত দূর আসা সহজ ছিল না:
গবেষণা করতে গিয়ে অর্থ ও যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততায় অনেকবার হোঁচট খেতে হয়েছে। আমাদের গবেষণা ফান্ড অপ্রতুল ছিল। গবেষণার কাঠামো ভালো না। ল্যাবেও প্রয়োজনমাফিক আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। অনেক জায়গায় ছোটাছুটি করে কাজটা এ পর্যায়ে এসেছে। করোনার কারণেও কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে।
পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ:
একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার মানেই এটা এখন ব্যবহার উপযোগী হয়ে যাবে তা নয়। এ জন্য এনিম্যাল মডেলে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ আরো অনেক ধাপ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের এখনকার লক্ষ্য এই অ্যান্টিবায়োটিক অধিক পরিমাণে উৎপাদন। যদি চাহিদামতো উৎপাদন করতে পারি, তাহলে দ্রুতই আমরা প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে হয়তো বাংলাদেশ অচিরেই নতুন একটি অ্যান্টিবায়োটিক উপহার দিতে পারবে বিশ্ববাসীকে। যেটা বাঁচাবে কোটি মানুষের প্রাণ।
সামনে আশার আলো:
এখন বিজ্ঞানীরা নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের খোঁজে হয়রান। সর্বশেষ অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপিনামও এখন ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা। মেরোপিনামের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে বলে খবর মিলছে। মানে চিকিৎসকদের হাতে এখন নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নেই। আইসিডিডিআরবিতে সংরক্ষিত আছে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়ার নাম জানি, যেটা ১২টি অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স। এ ধরনের একটি সুপারবাগ দ্বারা যদি কেউ আক্রান্ত হয়, তাহলে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই তার শরীরে কাজ করবে না। এসব দিক বিবেচনায় নতুন এই অ্যান্টিবায়োটিক অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তে উন্মোচন করতে পারে। নব আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিকটি একটি পেপটাইড (ছোট প্রোটিন) হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ গড়ে তোলার আশঙ্কা কম। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ‘হোমিকরসিন’ অ্যান্টিবায়োটিকের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।(কালেরকন্ঠ)