ছাতক প্রতিনিধি: ছাতকে কৈতক ২০ শয্যা হাসপাতালের ডা. মোজাহারুল ইসলামের দাপট দিন দিন বেড়েই চলছে। তার দাপটের কারনে ওই হাসপাতালের ডাক্তার থেকে শুরু করে নার্স, ঝাড়ুদার কেউই রক্ষা পাচ্ছেন না। তিনি এতই প্রভাবশালী ডাক্তার তার বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলতে নারাজ। জানা গেছে, ডা. মোজাহারুল ইসলামের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে হাসপাতালের ডা. জসিম উদ্দিন, ডা. জুনেদ হোসেন, ডা. আবু ছালেহীন খাঁন সবাই অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। ডা. জুনেদ হোসেন একপর্যায়ে হাসপাতালের ভিতরেই ডা. মোজাহারুল কর্তৃক শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হন। ডা. আবু ছালেহীন খাঁন ওই সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের দারস্থ হয়েছিলেন। এ নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান নিজ উদ্যোগে চেয়ারম্যানের অফিসে ছাতক উপজেলা আওয়ামীলেগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহবায়ক সৈয়দ আহমদ, প্রস্তুতি কমিটির সদস্য আফজাল হোসেন, পৌর আওয়ামীলীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ন আহবায়ক চান মিয়া চৌধুরী এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজীব চক্রবর্তীর উপস্থিতিতে ডা. মোজাহারুলকে তার আচরণ সংশোধনের জন্য বলা হয়। কিন্তু তারপরও তিনি হাসপাতালে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন । তার আচরণ ও দাপটের কারনে মনে কষ্ট নিয়ে নিজ ইচ্ছায় ডা. আবু ছালেহীন খাঁন কৈতক হাসপাতাল থেকে বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এভাবে একের পর এক অভিজ্ঞ ডাক্তারকে, মোজাহারুলের কারনে হাসপাতাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ডা. মোজাহারুল ইসলাম ডিউটি চলাকালীন সময়ে হাসপাতালে তার আবাসিক কোয়াটারে বসে প্রাইভেট রোগী দেখেন। রোগীদের কাছ থেকে প্রাইভেট ফি হিসেবে তিনি ৩০০ টাকা করে নেন। নিম্ন মানের ওষুধ কোম্পানী থেকে তিনি উপঢৌকন হিসেবে মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকেন। এজন্য তিনি হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে রোগীদের প্রেসক্রিপশনে এসব নিম্নমানের কোম্পানির ওষুধ লিখে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে রোগী ভর্তি হওয়ার পর ছাড়পত্র নিয়ে চলে যাওয়ার সময় রোগীর নামবিহীন ছাড়পত্র পূর্ব থেকেই ডা. মোজাহারুল ইসলাম তার ব্যবহৃত সীল স্বাক্ষর দিয়ে ছাড়পত্রের পিছনে তার নির্ধারিত ওষুধ লিখে নার্সদের হাতে ধরিয়ে দিতেন। এমনই রোগীর নামবিহীন একাধিক ছাড়পত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা সেবাদানের চেয়ে ব্যক্তি ফেইসবুক নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন বলে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান। তারা বলেন করোনা শুরুর প্রথম থেকেই কাজের চেয়ে বেশী নিজেকে ফেইসবুকে প্রচার করেছেন। এ জন্য তিনি ফেইসবুকপ্রেমী কিছু লোক ও নিয়োগ করে রেখেছেন তার গুনগান করতে। তারাই নিয়মিত ডা.মোজাহারুল ইসলামের গুনকীর্ত্তন করে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে। ডা. মোজাহারুল ইসলাম ২০১১ সালে এ হাসপাতালে যোগদান করেছেন। একই হাসপাতালে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চাকুরী করছেন তিনি। এ সুবাদে এখানে তার একটি বাহিনী রয়েছে। ডা. মোজাহারুল ইসলামের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কেউ কিছু বললেই তার উপর চড়াও হয় ওই বাহিনীর লোকজন। হাসপাতালের লক্ষ-লক্ষ টাকা ও করোনাকালীন সময়ে প্রবাসীদের দেয়া অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে। একক আধিপত্য বিস্তার, দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী, সিনিয়র স্টাফ নার্স, এমএলএসএস, ওয়ার্ড বয় এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী কেউই তার রোষানল থেকে ছাড় পাননি। ওই কারনে হাসপাতালের স্টাফরা ডা. মোজাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ করেছেন। মানববন্ধনে তারা অভিযোগ করেন, ডা. মোজাহারুল ইসলাম চাকুরিবিধি ভঙ্গ করে হাসপাতালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন। মালিক বনে যাচ্ছেন লক্ষ-লক্ষ টাকার। তিনি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়মিত খারাপ আচরণ করছেন। তার এসব স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জনসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। কর্মসূচির পর থেকে ডা. মোজাহারুল ইসলাম তাদের উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন বলে জানা গেছে। একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, একজন ইউপি সদস্য সহ জাউয়া, কৈতক, আগিজাল, চেচান, রুক্কা, গদারমহল, আমেরতল, ফুরকাননগর, টেটিয়ারচর, নাদামপুর এলাকার বেশ কিছু বাসিন্দারা জানান, ডা. মোজাহারুল ইসলাম একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার। কৈতক হাসপাতালের বাউন্ডারির ভিতরেই রয়েছে ডাক্তারদের আবাসিক কোয়াটার। কিন্তু আবাসিক কোয়াটারে পরিবার নিয়ে না থেকে অন্যত্র বসবাস করেন তিনি। আবার তার বরাদ্ধকৃত বাসার সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে আবাসিক কোয়াটারকে প্রাইভেট চেম্বার বানিয়ে সরকারি ডিউটির সময়ে তিনি রোগী দেখেন। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখলেও হাসপাতালের এন্ট্রি রেজিস্টারে ওই রোগীর নাম উঠান তিনি। এন্ট্রি রেজিস্টার প্রায়সময়ই তার প্রাইভেট চেম্বারে থাকে। রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলে ডা. মোজাহারুল ইসলাম উিউটিরত অবস্থায় তার ব্যবহৃত মোবাইল দিয়ে রোগীদের ছবি তুলে প্রায়ই তার ফেইসবুক আইডিতে আপলোড দিয়ে থাকেন। তার এহেন কর্মকান্ডে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ধর্মপ্রান মহিলা রোগীদের বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তিনি কথায় কথায় এক মন্ত্রীসাহেবের পিএস’র নিকট আত্মীয় বলে দাপট দেখিয়ে থাকেন। তিনি সাংবাদিককে টাকা দিয়ে হাসপাতালের এক সিনিয়র স্টাফ নার্সের বিরুদ্ধে নিউজ করিয়েছেন। আবার ওই নিউজের প্রতিবাদ দিতে সাংবাদিক মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। যা কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি তার দূর্নীতির নিউজ প্রকাশ হওয়ায় এক সাংবাদিককে নিজ ফেইসবুক আইডি থেকে একাধিক হুমকি দিয়েছেন তিনি। কিছু লোক দিয়েও তাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। ডা. মোজাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাংবাদিক ফজলুল হক নোমান ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি ছাতক থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এসময় দূর্নীতির নিউজ প্রকাশ করায় সরাসরি তিনি ওই সাংবাদিককে হুমকি দেন। সাংবাদিক ফজলুল হক নোমান এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন বরাবরেও একটি লিখিত অভিযোগ দেন। জানা যায়, পরবর্তীতে স্থানীয়ভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর হাসপাতালের সিনিয়র এক নার্স ডা. মোজাহারুলের বিরুদ্ধে সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক বরাবরে অভিযোগ দেন। এতে তাকে হেনস্থা করা ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি প্রদানের অভিযোগ আনেন ওই নার্স। হাসপাতালের স্টাফ ও স্থানীয়দের এরূপ আরো একাধিক অভিযোগ রয়েছে ২০ শয্যা বিশিষ্ট কৈতক হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. মোজাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ডা. মোজাহারুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনিত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ সামছুদ্দিন এ ব্যাপারে জানান, বিষয়টি তিনি দ্রুত খোঁজ নিয়ে দেখবেন।