মেডিকেলে চান্স পাওয়া দুই যমজ ভাইয়ের পিতা অটোরিকশা চালক বিল্লাল
‘আল্লাহর কাছে যা চাইছি, তার চেয়ে বেশি পাইছি’
তারিক চয়ন:সম্প্রতি দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে নতুন শিক্ষাবর্ষে (২০২০-২০২১) এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এবার মোট ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন শিক্ষার্থী মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন করেন যাদের মধ্যে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯২ জন পরীক্ষায় অংশ নেন। এ পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত হন ৪৮ হাজার ৯৭৫ জন। আসন সাপেক্ষে তাদের মধ্যে প্রথম ৪ হাজার ৩৫০ জন পরীক্ষার্থীকে সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সবাই জানেন, সরকারি মেডিকেল কলেজে লেখাপড়ার খরচ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের তুলনায় নামমাত্র। তাছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়া বাকিগুলো অত্যন্ত নিম্ন মানের। সবমিলিয়ে অবস্থাপন্ন এবং দরিদ্র নির্বিশেষে সব ধরনের পরিবারই মনেপ্রাণে চান তাদের সন্তান যাতে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়। তাই বাংলাদেশে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সত্যিকার অর্থেই খুব কঠিন। এটা পরীক্ষার প্রশ্নের কারণে যতোটা, তার চেয়েও বেশি প্রতিযোগিতার কারণে।
যে কারণে দেখা যাচ্ছে, এবার ১,২২,৮৭৪ জন আবেদনকারীর মধ্য থেকে মাত্র ৪,৩৫০ জন পরীক্ষার্থী সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন! হাতেগোনা এই নির্বাচিতদের মধ্যে যখন দেখা গেলো এদের মধ্যে দুজনই একই পরিবারের সন্তান এবং তাদের বাবা একজন হতদরিদ্র অটোরিকশা চালক তখন সেটা বেশ অবাক করার মতো ব্যাপারই বটে।
হ্যা, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার হাসিনাবাদ ইউনিয়নের মানরা গ্রামে এখন বইছে আনন্দের বন্যা।
ওই গ্রামের হতদরিদ্র অটোরিকশা চালক বিল্লাল হোসেনের যমজ দুই পুত্র সন্তান আরিফ হোসেন ও শরিফ হোসেন এবার এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে! আরিফ ৮২২ তম হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেলে এবং শরিফ ১১৮৬ তম হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এরই মধ্যে এ দুই মেধাবী ভাইয়ের সাফল্যের বিষয়টি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, প্রশংসিত হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, মাটির মেঝে আর সবুজ টিনের ছোট ঘরটিতে গিয়েও পরিবারটিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন অনেকে।
সন্তানরা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে কোটিপতি হবে সেটা তার চাওয়া নয় জানিয়ে বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আল্লাহর কাছে যা চাইছি, তার চেয়ে বেশি পাইছি। তারা চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করছে এটা যেনো দেইখ্যা যাইতে পারি। তাদের লেখাপড়া চালাইতে সবার সাহায্য চাই।’ নিজে এইচএসসি পাশ করলেও অর্থাভাবে লেখাপড়া চালিয়ে না যেতে পারায় আক্ষেপ করে তিনি জানান, সাইফুল ইসলাম নামে তার আরেকটি পুত্র এবং আমেনা আক্তার নামে একমাত্র কন্যা সন্তান রয়েছে। সাইফুল মাদ্রাসায় এবং আমেনা প্রাইমারি স্কুলে অধ্যয়ন করছে। চার সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রী মিলিয়ে মোট ছয় সদস্যের পরিবারে তিনি-ই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই সন্তান চিকিৎসক হয়ে দেশ ও জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে এটাই এখন তার আশা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালে উপজেলার মান্দারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে দুই ভাই এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেলে প্রথম তাদের মেধার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এলাকাবাসী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় কুমিল্লা সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পায় দু ভাই। তারা বলেন, বাবা খুব পরিশ্রম করেন। মা খুব উৎসাহ দেন। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে গণমানুষের সেবা করতে চাই। এজন্য শিক্ষক, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।
তাদের মা নাসরিন বেগম বলেন, ‘পাশ করছে এখন এইটাই আনন্দের বিষয়। এখন আমার আর দুঃখ মনে আসে না।’
এদিকে, দুই ভাইয়ের সাফল্যের খবর কুমিল্লার স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানার মাধ্যমে তাদের কাছে নগদ ২০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান পৌঁছে দেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ভবিষ্যতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেয়া হয়। এরপর মেধাবী দুই ভাই আরিফ ও শরিফকে পড়াশোনার জন্য এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মন্ত্রীর পক্ষে বিল্লাল হোসেনের হাতে সহায়তা তুলে দেন মনোহরগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম। শুক্রবার সকালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মেধাবী আরিফ ও শরিফ আমাদের এলাকার গর্ব। তারা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছে। এ খুশির খবরে উপহার হিসেবে এক লাখ টাকা পাঠিয়েছি। ভবিষ্যতেও তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
(দৈনিক মানবজমিন)