বিবিএন নিউজ ডেস্ক : ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ করার ক্ষমতা মূল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক বলেছিলেন, নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, করোনার মূল স্ট্রেইনের চেয়ে এটি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন।
হঠাৎ করোনার এমন ‘জেদের’ সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না দেশের হাসপাতালগুলো। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এসেই গেছে। এ কারণে এত দ্রুত ছড়াচ্ছে। যেহেতু বেশি মানুষ সংক্রমিত হবে, তাই বেশি আইসিইউ বা অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে।
এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে শনাক্ত পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৬ জন। সরকারি হিসেবে মোট মৃত্যু আট হাজার ৬৬৮ জন। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ ২০ হাজার ৭১৮জন।
অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত সপ্তাহের (৭ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ) তুলনায় চলতি সপ্তাহে (১৪ মার্চ থেকে ২০ মার্চ) রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে ৯১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বেড়েছে নমুনা পরীক্ষার হারও। গত সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৩২টি, চলতি সপ্তাহে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৬টি। গত সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছিলেন ছয় হাজার ৫১২ জন আর চলতি সপ্তাহে ১২ হাজার ৪৭০জন।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ১২০টি করোনারভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছে। যার মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল ইউকে ভ্যারিয়েন্ট।
এদিকে, আমাদের দেশেও ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন অণুজীব বিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা। তিনি বলেন, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু পরিমাণটা বের করতে পারছি না। কারণ দেশে যথেষ্ট সিকোয়েন্সিং হচ্ছে না। তবে এটা বলতে পারি, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট আছে এবং বেশ ভালো পরিমাণেই আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা প্রায় ৭০ গুণ বেশি এবং আমরা ধরে নিতে পারি আমাদের দেশে এটাই ছড়াচ্ছে।’
ইউকে ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি না মানাকেও দায়ী করেছেন ড. সমীর সাহা। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা খুবই অসেচতন। সেই সঙ্গে রয়েছে টিকা দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি অনীহা।’ ইউকে-তে অনেক সংক্রমণ হয়েছিল, অনেক মানুষ মারা গেছে। আমেরিকাতেও তাই হয়েছিল, ব্রাজিলেও তাই শোনা যাচ্ছে। এমন মন্তব্য করে ড. সমীর সাহা বলেন, আমরা যদি নিজেদের এখনই সীমাবদ্ধতার মধ্যে না রাখি, তবে কিছুদিন পর ইউকে ভ্যারিয়েন্ট বাংলা ভ্যারিয়েন্ট হয়ে যাবে।
“সেটা হলে বিপদ আরও বেশি। ইউকে ভ্যারিয়েন্টের জন্য আমাদের অত ভয় ছিল না। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট আমাদের জন্য ‘দারুণ কঠিন’হবে।”
ইউকে থেকে করোনা আসা বন্ধ করতে পারবো না মন্তব্য করে তিনি বলেন, একমাত্র উপায় হচ্ছে মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
গত জানুয়ারিতে সিলেটে সংক্রমিত হওয়া একজনের শরীরে যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট বি-ওয়ান ওয়ান সেভেন (B117) পাওয়া যায়।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, আইইডিসিআরের ল্যাবে মার্চে পর্যন্ত ১৪ থেকে ১৫ জনের শরীরে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
যেগুলো আমরা তাড়াতাড়ি পেয়েছি, তাদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। যদি পার্সেন্টেজ বেশি থাকে তবে বলতে পারবো ছড়িয়ে পড়েছে।
এই সময়ে সংক্রমণের হার এত বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানাটাই একমাত্র কারণ।
আগে তরুণদের সংক্রমিত হওয়ার হার কম হলেও নতুন ভ্যারিয়েন্টে শিশু ও তরুণরা আক্রান্ত হচ্ছে অনেক বেশি। এটা যুক্তরাজ্যেও দেখা গেছে। আমরাও তরুণ রোগী বেশি পাচ্ছি বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ।
তিনি বলেন, ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি কয়েকগুণ বেশি থাকায় অনেক বেশি মানুষ সংক্রমিত হবে। তাদের মধ্যে বয়স্ক ও জটিল রোগে যারা ভুগছেন তাদের অবস্থা খারাপ হবে।
এদিকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অনেকেই করোনার লক্ষণে ভুগলেও আরটি-পিসিআর টেস্টে নেগেটিভ আসছে। অথচ, আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে করা নমুনা পরীক্ষাকেই করোনা পরীক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায় মনে করা হয়। এর মাধ্যমে যে পরীক্ষা করা হয় তাকে বলা হয় টু-জিন পিসিআর টেস্ট।
তারা বলছেন, নতুন ইউকে ভ্যারিয়েন্টকে ডিটেক্ট করার মতো ক্যাপাসিটি টু-জিন পিসিআর টেস্টের কম। এখন আরটি-পিসিআর টেস্ট দিয়ে করোনা ডায়াগনোসিস করা যাচ্ছে না।
ডা. ফরহাদ উদ্দিন বলেন, ডায়াগনোসিস না হলেও রোগীকে করোনার চিকিৎসা দিতে হবে। ডায়াগনোসিস করার জন্য এক্সরে ও রক্তের পরীক্ষাও করাতে হবে।
‘নতুন ভ্যারিয়েন্ট আরটি-পিসিআর টুলে মিস হতে পারে’ জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, এজন্য সিটি স্ক্যান, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, লক্ষণ-উপসর্গ দেখে চিকিৎসা নিতে হবে।
জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে। এখন দরকার একে ভালোভাবে স্টাডি করা।’(জনমত )