বীর, বিদায় কিন্তু বলছি না
…
‘দূরের গ্রাম-ঘাটের কথা-হাটের কথা-ইস্টিশনের কথকতা… ।’ এ রকম শিরোনাম বিষয় নির্ধারণ করে ভোরের কাগজে ক্রমিক প্রতিবেদন ছাপা হতো। আমি তখন পাঠক। এসব পাঠের মধ্যে অনেক অজানা কথা জানা হতো। আনন্দের সঙ্গে পাঠ করতাম। যখন এই কাগজের প্রতিনিধি হলাম, তখন পাঠক থেকে লেখক। মাসে অন্তত চার থেকে পাঁচটি এই ক্রমিক প্রতিবেদন লিখতাম আমি। যেদিন ছাপা হতো, আগের দিন ঘোষণা আসত। আমি লেখক, আমিই পাঠক, অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। এই পর্বের অনেকগুলো প্রতিবেদন করছিলাম। দূরের গ্রামে লক্ষীপুরে ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা, হাটের কথায় বিখ্যাত বাংলাবাজারের নাম বদল করে ‘জয়বাংলাবাজার’ নামহরণ প্রভৃতি। প্রতিবেদনে সাধারণ মানুষের বর্ণনা বেশি থাকতো। মিসবাহ ভাই (সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ) তখন তরুণ আইনজীবী।বাংলাবাজারপত্রিকায় একটি মেরুকরণ হলে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এর আগে আমরা মানে পংকজ দা (সুনামগঞ্জের খবর সম্পাদক, পংকজ দে) সুনামগঞ্জের সাংবাদিকতায় পেশাদারি মনোভাব গড়তে তৎপর। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাকে সঙ্গী করি। দিনমান সরেজমিন ঘুরে তথ্য সংগ্রহে মনোনিবেশ বেশি। আমি দেখা থেকে লেখায় পারদর্শী হতে চাই। ভোরের কাগজের একজন পাঠক হিসেবে পাঠ করা সেই সব ক্রমিক প্রতিবেদন তৈরি একে একে শুরু করি। ‘জয়বাংলাবাজার’ তথ্য হাটের কথায় ওঠে আসে যেদিন, সঙ্গত কারণে মুক্তিযোদ্ধা মহলের দৃষ্টি কাড়ে। খসরু ভাই সুনামগঞ্জ জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী। মিসবাহ ভাই আমাকে বলেছিলেন, সিনিয়র তোমার লেখার ভক্ত। দেখতে চাইছেন, চলো। ভেসপার পেছনে বসিয়ে আমাকে এক টানে আইনজীবী সমিতির ভবনে নিয়ে গেলেন। খসরু ভাইকে আগে থেকেই চিনি। মুখোমুখি হই, এক সাক্ষাতেই বড় আপন। দেখেই বললেন, ‘ও তুমি তো দেখি আমরার ডাক্তার সাবের ছেলে! দেখবার লাগিই মিসবাহরে বলছিলাম!’
পারিবারিকভাবে চেনা, কিন্তু নামে-মানুষে অচেনা ছিলাম। খসরু ভাই চিনলেন। সেই যে চেনা, সেই যে সম্পর্ক, সেটা মিহিসুতার বাঁধনের মতো। দেখা যাবে না, কিন্তু অটুট বাঁধন। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে খসরু ভাই আমাদের সাংবাদিকতারও অগ্রজ। অভিভাবকের মতো করে আগলে রেখেছেন আমৃত্যু। তাতে কোনো ছেদ পড়েনি। খসরু ভাই রাগ করেছেন, এমনটিও হয়নি কোনোদিন। মৃত্যু অকস্মাৎ, ২৪ ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটায়। খবরটা প্রথম খলিল রহমান (সুনামগঞ্জে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক) ফোন করে দেয়। কাঁদছিল খলিল, সাংবাদিকতা-আইনপেশা-এ দুটোতেই খসরু ভাইয়ের খুব কাছের একজন খলিল। ঠিক করে কথাও বলতে পারছিল না। আমি ভেবেছিলাম আমাদের কোনো স্বজন বিয়োগের খবর জানাতে ইতস্তত করছে। খসরু ভাই নেই বলতেই আমি স্তম্ভিত। তারপর পংকজদার সন্ত্রস্ত ফোন। ইতিউতি করে খবর পেয়েছি কি না, জানতে চাওয়া। আমি নির্বিকার। একটু আগে খলিলের বলা কথাটা যদি ভুল হয়, এই আশায় কান পাতি পংকজদার কথায়। কিন্তু না, সেই কঠিন সত্যটাই আবার শোনানো হলো একটু ঘুরিয়ে। পংকজদার কথায় আমার আর্তনাদ চাপা দিতেই কথার মাঝখানে ফোন কেটে দিলাম।
অফিসের কাজে মন আর নেই। কম্পিউটার বন্ধ করব। তার আগে ফেসবুকে একটু চোখ রাখি। না কেউ কিছু লিখেনি এখনো। ‘বজলুল এম খসরু’ আইডিতে যাই। সর্বশেষ স্ট্যাটাস দেখি। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অ্যালবামে গিয়ে একটি ছবি বের করি। সিরাজুল আলম খানের বই হাতে খসরু ভাই। এই বইয়ের কথার সঙ্গে খসরু ভাইয়ের গল্প অনেক আগেই শোনা। বইসমেত ছবিটি নিয়ে বীরের বিদায় নেওয়া নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিলাম। এই অবেলায়, এই কাজের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত আমি, আমরা-সবাই!
কী লিখব খসরু ভাইকে নিয়ে? মাথার ওপর আমার আকাশ। সেই আকাশেই তো খসরু ভাই অভিভাবকের মতো ছাতা হয়ে ছিলেন। বাসায় গেলে খসরু ভাইকে রেখে আমরা ভাবীর (কবি মুনমুন চৌধুরী) সঙ্গে বেশি গল্প করতাম। কবিতা নিয়েই বেশি আলাপ হতো। আর খসরু ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ চলত সমাজ-সংস্কৃতির ধীমান সব বিষয় নিয়ে। এরমধ্যে বড় একটি অধ্যায় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে সেলা সাব সেক্টরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন খসরু ভাই। মিহিসুতার কথা বলছিলাম, এই মিহিসুতার বাঁধন খসরু ভাইয়ের সঙ্গে দুই যুগের।আর খসরু ভাইকে জানা ও শোনা আরও কয়েক দশক আগের।
দোয়ারাবাজার তো প্রতিবেশী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার। আব্বাকে তিনি চিনতেন, আব্বাও ভালো করে জানতেন। একবার নির্বাচনও করেছিলেন। ‘বিএম খসরু’ নামে ব্যাপক পরিচিতি ছিল। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার খসরু ভাই ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তারপর ওই ধারায় পথ চলেছেন। অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিয়ে সেই কৈশোর চৈতন্য সাদা জাগ্রত ছিল। জীবনের সবচেয় বড় যে অধ্যায়, সেটি মুক্তিযুদ্ধ। খসরু ভাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন। যে সময় মুক্তিযোদ্ধারা মুখ লুকিয়ে চলতেন, খসরু ভাই মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বীরদর্পে অগ্রসরমান ছিলেন। অনেক বীর সংসারসংগ্রামে জর্জরিত। খসরু ভাই তাঁদের পাশে ত্রাতার মতো ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গর্বে ভরা মনের খসরু ভাইকে খুশি করতেই আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র’ নামের গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাকর্মী ছিলাম। গণমানুষের নেতা বরণ রায়কে নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় সংবর্ধনা গ্রন্থ ও বরুণ রায়কে নিয়ে সান্ধ্য আড্ডার আয়োজক ছিলাম আমরা। বীর নারী কাকনবিবিকে পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে আনার সূত্রধর ছিলেন খসরু ভাই। কাকনবিবিকে চেনার আগে খসরু ভাই প্রথম তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা (খসরু ভাই, মিসবাহ ভাই ও আমাদের সাংবাদিকতার আরেক অগ্রজ বাবলু ভাই: সাংবাদিক-আইনজীবী আইনুল ইসলাম বাবলু) গিয়েছিলাম কাকন বিবির শনঘরে।
শুধু কি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকনবিবি? একটু পেছন ফিরে তাকালেই কতশত স্মৃতি ভাসে। সুনামগঞ্জে থাকতে আমার যে সকল প্রতিবেদন সাহস ছড়িয়েছে, সেই সব প্রতিবেদন পরবর্তী অবস্থায় রাজনৈতিক কারণে নতজানু চরিত্রে দেখেছি অনেকের মধ্যেই। কিন্তু অবিচল দেখেছি শুধু খসরু ভাইকে। যে কথা বলতেন, স্পষ্ট করেই বলতেন। স্পষ্টবাদিতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। এ জন্য আমাদের অভিভাবকত্বের ছাতাটা তাঁর হাতেই সমর্পিত থাকত সবসময়। দ্বিমত থাকলে তা-ও ব্যক্ত করতেন। কিন্তু এই মত-মতান্তরে বাদানুবাদ হতো না। মনে পড়ে, ২০০৪ সালে টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণ নিয়ে আমি একাই ছিলাম সোচ্চার। ইজারাপ্রথা বাতিল হোক, সেই দাবিতে খসরু ভাই-ও একমত। কিন্তু ইজারা পরবর্তী অবস্থা কী হবে, সেখানে খটকা ছিল খসরু ভাইয়ের। সেই খটকা খণ্ডন হয়নি, কিন্তু তাই বলে আমার সঙ্গে কোনো মতবিরোধ হয়নি। খসরু ভাই বলতেন, তুমি যে একাই দাঁড়িয়েছো, সেটাই সবচেয়ে সাহসের, আকর্ষণের।
রাজনীতি করেছেন, দেশের বাইরেও কাটিয়েছেন দীর্ঘ একটা সময়। তার আগে কিছু দিন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা করেছেন। আইনপেশায় জড়ানোর সময় আরেকবার সাংবাদিকতা ভর করেছিল। একটি ঐতিহাসিক সময়ে, সুনামগঞ্জ যখন জেলা ঘোষণা হয়, সেই দিন সুনামগঞ্জের প্রথম সংবাদপত্র ‘সুনাম’ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। সাংবাদিক-সম্পাদকও। স্থানীয় ইতিহাসের একটি বাঁকে তাঁর সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র সম্পাদনা অমরত্ব পেল। এ জন্যই আইনপেশায় ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সাংবাদিকতার গতিপথে লক্ষ্য রাখতেন খসরু ভাই। পংকজদা যখন অসম এক সাহসের পদক্ষেপ নিলেন, দৈনিক পত্রিকা বের করবেন। খসরু ভাই পাশে ছিলেন। পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক অলংকৃত করেছেন শুরু থেকেই। আমরা সাংবাদিকতা করেছি, করছি। আইনি সহায়তা অথবা তথ্য ঘাটতির কোনো সংকটে উদার আকাশের মতো পাশে পেয়েছি তাঁকে। সাংবাদিকতা ছাড়াও জনজীবনে, রাজনৈতিক সংকটেও খসরু ভাই অবিচল থাকতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও গুণীজনদের আগলে রাখার অসম্ভব এক ঐকতান-শক্তি খসরু ভাই লালন করতেন। বিরল এই গুণাবলীর দ্বিতীয়জন এই সুনামগঞ্জে আর নেই।
যাত্রাপালার একটি চরিত্র আছে। ‘বিবেক’ বলা হয়। কাহিনি থেমে গেলে বা আটকে গেলে গান অথবা অকস্মাৎ বিবেক চরিত্র হাজির হতো। তাঁর নির্দেশিত পথে কাহিনি এগিয়ে শেষে সুন্দর এক পরিসমাপ্তি ঘটত। আমাদের এই বাস্তব জীবন-যাত্রায় খসরু ভাই ছিলেন সবসময়ের জন্য একজন ‘বিবেক’। আইন-আদালত-সমস্যা-সংকট কিংবা গণমানুষের পাশে দাঁড়াতে আমরা ‘বিবেক’ নামের মানুষটি থেকে প্রেরণা পেতাম। বিবেকতাড়িত হতাম, পরামর্শ চাইতাম। যত ব্যস্ততা থাকুক, সবকিছু সরিয়ে সুন্দর সমাধান আমাদের দিতেন খসরু ভাই।
২০১৭ সালে হাওরের ফসলহানির সময়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলনে খসরু ভাই যখন গহিন থেকে গহিনে যাচ্ছেন, অবিচলভাবে মানুষের পাশে আছেন। মিহিসুতা মানে অদেখা সুতোর টানে যোগাযোগ রাখি। নিরন্ন মানুষের জন্য সেই আন্দোলন ভোটের রাজনীতির গ্রাস থেকে রক্ষায় তিনি সোচ্চার ছিলেন। হাওর নিয়ে সরেজমিন কয়েকটি প্রতিবেদন প্রথম আলোয় ছাপা হয়। খসরু ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাই, আর কী কী করা যায়। বললেন, যে কোনো সংকটে তো পথ দেখায় প্রথম আলো। বছর বছর এই ফসলহানি, কী করণীয়-এই বিষয়টি সামনে আনা দরকার। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানালাম, সেই সমাধান-পরামর্শ আমি হাওরের মানুষজনকে সম্পৃক্ত করতে চাই। খসরু ভাই ‘ওয়েল’ তাই করো। আয়োজন করা হলো গোলটেবিল বৈঠক। ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল সেই গোলটেবিল বৈঠক হয়। হাওর ইস্যুতে হাওর এলাকায় গিয়ে প্রথম আলো গোলটেবিল করেছিল বলে খসরু ভাই কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছিলেন দরাজ কণ্ঠে।
মানুষের চলে যাওয়ার পর আমরা শেষটা নিয়ে বেশি ভাবি। আমিও ভাবছি। খসরু ভাইয়ের জীবনের শেষটা অন্য রকম ছিল। হাওর নিয়ে শুধু ভাবনা নয়, প্রতিবাদে এককাট্টা হন। ফসলহানির ঘটনায় অরাজনৈতিক নাগরিক প্লাটফরম তাঁর নেতৃত্বেই হয়েছে। শরীর-মন চাঙা রাখতে প্রভাত ব্যায়ামেও সক্রিয় ছিলেন খসরু ভাই। তাঁর হাত ধরে সুনামগঞ্জ শহরে একটি ‘সোনালী প্রভাত’ রচিত হয়েছে। সেই জাগরণ ভোরের পাখির মতোই।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কাল নিয়ে লেখালেখিতে সময় দিচ্ছিলেন বেশি খসরু ভাই। রচিত হয়েছে অনেকগুলো বই। ইতিহাসের বড় উপাদান সেগুলো। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা করছেন, বিশেষ করে তরুণ গবেষক কিংবা গণমাধ্যম কর্মী, তাঁদের সঙ্গেও ছিল মিহিসুতার মতোই যোগাযোগ। দেখা যেত না, কিন্তু বোঝা যেত।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি সুবর্ণ সময় সন্নিকটে। আসছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন হবে। তার আগেই এক বীরের বিদায়ে বিষন্ন আমরা। কী করে সইব এই বিয়োগ? অনেক কাজই তো করার কথা ছিল তাঁর। সেই গুলো অকথিত হয়েই থাকল। বীরত্ব বেঁচে থাকে বলে বীরের তো মৃত্যু নেই। বীর খসরু ভাই, বিদায় কিন্তু বলছি না!
উজ্জ্বল মেহেদী। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট।
দৈনিক প্রথম আলো