নবাব উদ্দিন:প্রতিদিন মৃত্যুর শতকরা হার বাড়ছে হু হু করে। বিলেতে লকডাউন আরো কঠোর হচ্ছে; দিন অতিবাহিত করছি আতংকে। এ এক দুঃসময়। আজ প্রায় ১০ মাস ঘরবন্দি। ফোন ধরতে ভয় পাচ্ছি। পত্র-পত্রিকা আর ফেইসবুক খুঁলেই শুধুকরোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর। এখন শেষ রাতে আর ভোরে রিং বাজলে এক ভয় মনের মধ্যে জেগে ওঠে।
গত দশ মাসে বিলেতে বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে যত মৃত্যু দেখেছি তা গত পাঁচ দশকে দেখি নি। সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছা। করোনা পাল্টে দিচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রা। এর ফলে আমাদের জীবন আরো বেশি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর হচ্ছে। এখন অনেক জানাজা, দোয়া মাহফিল, বিয়ে, সমাবেশ এবং অনুষ্ঠানাদি জুম, টিমস ও স্কাইপ নির্ভরশীল। কিন্তু টিভি খুললেই দেখছি মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন গড় অনুপাতে বাড়ছে। কী এক আতংক!
এই একটি সাধারণ ভাইরাস আমাদের সবার জীবনকে একবারে থমকে দিয়েছে। পৃথিবীতে এর আগেও মহামারী হয়েছে। এই শীতে আমাদের জীবনকে এই নতুন ভাইরাস আবারও বদলে দিচ্ছে। কী অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত আচরণ করে এই ভাইরাস! আমাদের শরীরে যখন কোভিড দেখা দেয় তখন কিন্তু কেবল ফুসফুসই রোগাক্রান্ত হয়না বরং এ ভাইরাস আক্রমণ করে পুরো শরীরের উপর।
পুরো ২০২০ সালটি ছিল করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে বিধ্বংসী এক বছর। সারা বিশ্বের মত বিলেতকে বিপর্যস্ত করেছে এই ভাইরাস। বেড়েছে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা। টিকা আবিষ্কার হয়েছে। অক্সফোর্ডের টিকা ৪ জানুয়ারি থেকে মানবদেহে দেয়া শুরু হয়েছে।
আল্লাহই আমাদের এই ভাইরাস থেকে উদ্ধার ও রক্ষা করতে পারেন। তাছাড়া আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে বার বার হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর মুখে মাক্স পরা। প্রত্যেকটি মানুষের কাছে এই ভাইরাসটি বিরাট আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমরা যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আগামী দিনগুলাতে অর্থনীতি কোন পর্যায়ে মোড় নিবে তাও অনিশ্চিত।
২০২০ সাল পৃথিবীর এবং মানব জীবনের ইতিহাসে এক বিষাদময় ঘটনাবহুল বছর। এটি একটি স্মরণীয় সাল হিসেবে ইতিহাসেলিপিবদ্ধ হবে। বছর জুড়ে মহামারির খবর, যা সাড়া পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছে; মানুষের জন্য বিরাট যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্মরণীয় ঘটনা বেক্সিট, বৈরুতে বিষ্ফোরণ, সারা বিশ্বে জর্ড ফ্লয়েড ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যটারস আন্দোলন, আমেরিকার নির্বাচন এবং বিশ্ব জুড়ে মহামারি ও অন্যান্য ঘটনাবলি।
এই ২০২০ সালে আমরা সবচেয়ে বেশি বিলেতে বাঙালি কমিউনিটির প্রবীণ ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্বদের হারিয়েছি, যারা কমিউনিটির আন্দোলন করে আমার জীবন যাত্রা এই প্রবাসে সহজ করে দিয়েছেন এবং এই প্রবাসে সসম্মানে ঠিকে থাকারভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। বস্তুত তারা ছিলেন আমাদের কমিউনিটির প্রাণপুরুষ।
আমাদের বাঙালি কমিউনিটি যেন এখন একটি প্রাণহীন মানবসমাজ। যে কমিউনিটি বছরে ৩৬৫ দিনই জেগে থাকতো বিয়ে, ওয়ালিমা, রাজনৈতিক মিটিং, পাল্টা-পাল্টি সংগঠনের মিটিং, চ্যারেটি মিটিং, মেলা, সম্মেলন, ওয়াজ মাহফিল, তাফসির, আড্ডা, গোপন বৈঠক, দলা-দলি, নৌকা বাইছ, নাটক, বই মেলা ইত্যাদি ইত্যাদিতে, সেই কমিউনিটি এখন নিথর, প্রাণ শক্তিহীন। আমরা যেন এক আতংকের মধ্যে বাস করছি। ফেইসবুক আর ওয়াটস্আপ খুললেই শুধু মৃত্যু আর করোনাক্রান্তের খবর। একই সাথে হু হু করে বাড়ছে বিলেতে বেকারত্ব, বাড়ছে আর্থিক সংকট, বাড়ছে পারিবারিক ও মানসিক যন্ত্রণা, বাড়ছে নতুনভাবে বেঁচে থাকার আকুতি।
প্রতিদিন একটি অনিশ্চিত দিন। সকাল শুরু হয় মৃত্যুর সংবাদ আর করোনা আক্রান্তের খবর দিয়ে। বিছানায় যাই একই দুঃখের সংবাদ মনের ভেতরে জমা করে। রবের নাম নিয়ে ঘুমে যাই। জানি না কখন কী হবে। মৃত্যু কখন হবে তা আমরা কেউ জানি না, কিন্তু মনে হয় এ জীবনে যেন এক সেকেন্ডেরও ভরসা নেই। এই বছরে আমার প্রায় ১৪ জনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবমারা যান। এর মধ্যে আমার তিনজন ঘনিষ্ঠ স্কুল সহপাঠিকে হারিয়েছি। আমরা সবাই একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছি।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, আমি এখনও বেঁচে আছি। প্রত্যেকটি মৃত্যু অত্যন্ত কষ্টের কিন্তু ঘনিষ্ঠ স্কুল জীবনের বন্ধু বাবলুর (সায়মন) মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অকালে চলে গেল। চলে গেল গিয়াস ও সালেহ। মনে হচ্ছে এই ভাইরাস এক প্রাণঘাতী রূপ ধারণকরেছে। অনুভব করছি আমরা সবাই কতটা অসহায়। আমাদের বাঙালি কমিউনিটির যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হারিয়েছি, বিশেষত যাদের সাথে আমার ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সম্পৃক্ততা ছিল তাদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করলাম:
১। হারুনুর রশিদ (বিয়ানীবাজার) লাইফ মেম্বার, বাংলাদেশ সেন্টার।
২। কামাল জাহাঙ্গীর মিয়া, ব্যবসায়ী, লাইফ মেম্বার, বাংলাদেশ সেন্টার, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রিটিশ বাংলাদেশ ক্যাটারার্সএসোসিয়েশন।
৩। ডঃ মামুন রহমান, একাউন্টটেন্ট, বাংলাদেশ সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাষ্টি।
৪। খালেদ চৌধুরী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, স্থায়ী মেম্বার ও উপদেষ্টা বাংলাদেশ সেন্টার।
৫। আলহাজ্ব হাফিজ মজির উদ্দিন, বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা, বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ সেন্টারেরঅন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
৬। আলহাজ্ব উস্তার আলী, বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা, বাংলাদেশ সেন্টারের স্থায়ী সদস্য।
৭। মোঃ নিজাম উদ্দিন, ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সেন্টার।
৮। রউফুল ইসলাম, বিয়ানীবাজার ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ সেন্টারের স্থায়ী সদস্য।
৯। খন্দকার ফরিদ উদ্দিন, বাংলাদেশ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রাক্তন ট্রেজারার।
১০। মোহাম্মদ আব্দুর রহমান, ব্রিক লেনের বিশিষ্ট পুরাতন ব্যবসায়ী, বিউটি ক্লথ ষ্টোরের স্বত্বাধিকারী।
১১। নাজিম আহমদ, প্রাক্তন ব্যাংকার, চ্যানেল এস ও বাংলা টিভির সেলস ম্যানেজার।
১২। এনামুল হক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান, সুরমা সেন্টার ।
১৩। আব্দুস সালিক, কমিউনিটি নেতা, শিল্পী ও ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবক।
১৪। গোলাম আবু সালেহ শুয়েব, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ।
১৫। আলহাজ্ব সৈয়দ আব্দুর রহমান, বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব।
১৬। আলহাজ্ব গোলাম মোস্তফা চৌধুরী এমবিই, বিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব, সংগঠক ও সমাজসেবক।
১৭। সাদ গাজি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিসিএ ও সিনিয়র ডাইরেক্টর বিবিসিসি।
১৮। মাওলানা আব্দুর রব, দারুল উম্মাহসহ বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা।
১৯। মোঃ জয়নুল আবেদীন, মিডলসেক্স বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা।
২০। মুহাম্মদ গৌছ খান, বিশিষ্ট বিচারী ও সালিশ ব্যক্তিত্ব।
২১। সৈয়দ জুরন আলী, গ্রেটার সিলেট কাউন্সিলের অন্যতম সংগঠক ও সুরমা সেন্টারের সাবেক ট্রেজারার।
২২। কবি রহমত আলী পাতনী, সাহিত্য সংগঠক ও সমাজসেবী।
২৩। হাজি আব্দুল আহাদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবী।
২৪। এম এ মান্নান, ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সভাপতি।
২৫। ওমর ফারুক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ক্যামডেন কাউন্সিলের সাবেক মেয়র।
২৬। মুহাম্মদ আলী ইসমাইল, বৃটেনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
২৭। আল্লামা মুজাহিদ চৌধুরী দুবাগী, প্রায় ২০টি ইসলামী গ্রন্থের লেখক।
২৮। নুনু মিয়া, নিউপোর্ট সিটি কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলার।
২৯। আব্দুল মতিন মতি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।
৩০। আবুল কামাল, সেন্ট্রাল লন্ডন সুরমা সেন্টারের সাবেক সভাপতি।
৩১। সাবেক এমপি আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিম, যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে মৌলবীবাজার-রাজনগরআসনের সাবেক সংসদ সদস্য, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
৩২। সৈয়দ উমর আলী, শেরপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের সাবেক ট্রেজারার ,বিশিষ্ট একাউন্টেন্ট ও চ্যারটি এডভাইজার
৩৩। মইনুল ইসলাম বাবলু, (আমার ঘনিষ্ট বন্দু)।
৩৪। আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ চৌধুরী, বৃটেনে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, বিশিষ্ট সমাজসেবী। তিনি দাওয়াতুলইসলামের জেনারেল সেক্রেটারী ও নায়েবে আমীর, ইষ্ট লন্ডন মসজিদের ট্রাষ্টি ও শেডওয়েলে দারুল উম্মাহ সেন্টার ও মসজিদপ্রতিষ্ঠায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
৩৫। মুজিবুর রহমান চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বৃহত্তর সিলেটের নবিগঞ্জের কামারগাউ (পুরাদিয়া) নিবাসীবিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব।
৩৬। ডা: আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সল। পেশাজীবি।
আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে ২০২০ সাল অতিক্রম করেছি; হারিয়েছি অনেক প্রিয়জনকে। ২০২১ সালে আমরা হয়ত আশার আলো দেখতে পাবো। আশা নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে চাই, বেঁচে থাকতে চাই স্বপ্ন নিয়ে। আমরা নিশ্চয়ই সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব, ইনশাল্লাহ।
লেখক:সাবেক সম্পাদক সাপ্তাহিক জনমত। সাবেক সভাপতি, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব। চেয়ারম্যান: ইস্টহ্যান্ডস দাতব্য সংস্থা।
Email: nobab@btinternet.com