বিবিএন নিউজ ডেস্ক: শ্রীলঙ্কায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মুসলমান ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের লাশ ধর্মীয় পদ্ধতিতে দাফন করার পরিবর্তে দাহ করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে শ্রীলঙ্কান সরকার মুসলমানদের লাশকে অন্যায়ভাবে কভিড-১৯ পজেটিভ হিসেবে শনাক্ত করে জোর করে দাহ করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মারা গেলে তার লাশকে পজিটিভ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। আলাদাভাবে পরীক্ষার আবেদন গ্রহণ করা হয় না। ইতোমধ্যে প্রায় ২০০ করোনা আক্রান্ত মরদেহ দাহ করা হয়েছে, তার মধ্যে অর্ধেক মুসলমানদের লাশ। এতে ২০ দিনের একটি মুসলিম শিশুও রয়েছে। শ্রীলঙ্কার আদালত ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর করা মামলা কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ না দেখিয়েই খারিজ করে দিয়েছে।
তাই যুক্তরাজ্যে বসবাসরত শ্রীলঙ্কান কমিউনিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিষয়টি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। মুসলমান ও খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী লাশ দাফনের অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারে সে ব্যাপারে তাঁরা সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। গত ৪ জানুয়ারি সোমবার সন্ধ্যায় লন্ডনে করডোবা ফাউন্ডেশন ইউকের উদ্যোগে স্থানীয় বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক ভার্চ্যুয়াল প্রেস ব্রিফিঙে উপরোক্ত দাবী জানানো হয়। করডোবা ফাউন্ডেশন ইউকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আবদুল্লাহ ফালিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রাখেন, শ্রীলঙ্কান হ্যারিটেজ-এর লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার লোকমান হারিস এমবিএ, প্রাইমারি কেয়ারের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসক জিপি ফিরোজ মোবারক ম্যাসেঞ্জার, শ্রীলংকান ইসলামিক ফোরাম ইউকের প্রেসিডেন্ট জাজিল ফ্যাজি, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসিলম সেন্টারের ডাইরেক্টর দেলওয়ার খান ও মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির ডেপুটি চেয়ার ব্যারিস্টার সালমা ইউসেফ।
এতে সংবাদিকদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের প্রেসিডেন্ট, সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক মোঃ এমদাদুল হক চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, প্রেসক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমদ, সাংবাদিক মাহবুব রহমান, সাপ্তাহিক বাংলাপোস্ট সম্পাদক ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী, সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ, চ্যানেল এস এর সিনিয়র রিপোর্টার ইব্রাহিম খলিল ও টিভিওয়ানের সিনিয়র রিপোর্টার জাকির হোসাইন কয়েস।
লোকমান হারিস এমবিএ :
প্রেস ব্রিফিংয়ে লোকমান হারিস বলেন, শ্রীলঙ্কা সরকার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সব লাশকেই দাহ করতে বলেছে। এক্ষেত্রে তাদের ধর্মও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি হয়তো নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে। কিন্তু নিবীড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ ছাড়াই মুসলমানদের লাশ দাহ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও লংঘন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে। তিনি আরো বলেন, আজকের বিশ্ব দুটি সমান্তরাল মহামারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত। এক দিকে করোনাভাইরাস, অন্যদিকে করোনার কারণে সৃষ্ট বৈষম্য। এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার অবস্থান হচ্ছে, বর্ণবাদ রাষ্ট্র আরোপিত। এই বর্ণবাদকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি হঠাৎ করেই হয়ে গেছে এমন নয়। এর একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বর্ণবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্ণবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত তামিলদের নেতৃত্বে ৩০ বছর ধরে একটি লড়াই চলে। ২০০৯ সালে এই লড়াই শেষ হওয়ার পর মুসলমানরা এখন তাদের নতুন শত্রু।
২০১৯ সালের বোমা হামলার পর করোনা বর্ণবাদ, করোনা ইসলামভীতি বেড়েছে। বর্তমান সরকার এবং কিছু গণমাধ্যম বলতে শুরু করে মুসলমানদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য অন্যায়ভাবে মুসলমানদের দায়ী করা হচ্ছে। এখন মুসলমানদের লাশ জোর করে পুড়িয়ে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারকে অবশ্যই জবাবদিতি করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বহু চিকিৎসা সংগঠন বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন। ভাইরাসবিদ ও জীবাণুবিদ এবং এ সংক্রান্ত প্যানেল শ্রীলঙ্কা সরকারকে জানিয়েছে, দাফন নিরাপদ। তবে শ্রীলঙ্কা সরকার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যায় আগ্রহী নয়।
জাতিসংঘ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর জোর করে লাশ দাহ করার বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া মানবাধিকার লংঘন। যেখানে তাদের ধর্মীয় অনুশাসনে বলা হয়েছে, উপযুক্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রমাণ ছাড়া লাশ পোড়ানো যাবে না। এমনকি শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কমিশনও একই কথাই বলেছে। বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গোষ্ঠী প্রধানের বক্তব্যও এ কথাকে সমর্থন করেছে। কিন্তু এসব কথায় কর্ণপাত করছেনা।
জিপি ফিরোজ মোবারক ম্যাসেঞ্জার :
ব্রিটেনে প্রাইমারি কেয়ারের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসক জিপি ডা. ফিরোজ মোবারক বলেন, শ্রীলঙ্কায় মূলত মুসলমান ও খ্রিস্টানরা লাশ দাফন করে থাকে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যেও এ প্রচলন আছে তবে তার সংখ্যা অত্যন্ত কম। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ সম্প্রদায় দাহ বেশি করে। শ্রীলঙ্কা একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশ। এক দেশ, এক শাসনণ্ডনীতিতে পরিচালিত হয় দেশটি। বর্তমানে সেখানে দাহ না দাফনণ্ডএ নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সরকার গোড়ার দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে কভিড-১৯ আক্রান্তদের সৎকারের ব্যবস্থা করে। ওই নির্দেশনায় দাহ বা দাফনের কথা বলা হয়েছে। প্রথম বাধতামূলকভাবে লাশ পোড়ানোর পর শ্রীলঙ্কার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিষয়টি রাজনৈতিক রূপ পায়। রাতারাতি সরকার তাদের গেজেট থেকে কভিড আক্রান্ত বা সন্দেহভাজনদের মৃতদেহ দাফন করার অনুমতি দেওয়ার অংশটি তুলে দেয়। শ্রীলঙ্কার মুসলিম জনগোষ্ঠী মাত্র ১০ শতাংশ। তবে করোনায় মৃতদের অর্ধেকই মুসলমান। যদিও শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের মাধ্যমেই কোভিড ছড়াচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবে কভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যদি মারা যায় তাহলে তার লাশকে পজিটিভ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। আলাদাভাবে পরীক্ষার আবেদন গ্রহণ করা হয় না। মুসলিম সমাজে উদ্বেগ রয়েছে, মুসলিমদের লাশকে অন্যায়ভাবে কভিড-১৯ পজেটিভ হিসেবে শনাক্ত করে তাদের জোর করে দাহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সালমা ইউসেফ :
মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন (এমসিবি) লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির ডেপুটি চেয়ার ব্যারিস্টার সালমা ইউসেফ বলেন, এমসিবি শ্রীলঙ্কা সরকারের ‘বাধ্যতামূলক দাহ’ নীতির বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই টাস্কফোর্সে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ, আইনী ও চিকিৎসা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমসিবি টাস্কফোর্সকে আইনজীবীদের আইসিসিপিআরের অধীন হিউম্যান রাইটস কমিটির কাছে অভিযোগ করার নির্দেশনা দিয়েছে। আইসিসিপিআরের আওতায় বর্ণিত মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে। মুসলিম ও খ্রিস্টান সদস্যদের তাদের পরিবারের ইচ্ছা ও ধর্ম চর্চার বিরুদ্ধে গিয়ে দাহ করা হচ্ছে।
ডা. আবদুল্লাহ ফালিক :
করডোবা ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আবদুল্লাহ ফালিক বলেন, “কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই শ্রীলঙ্কায় ‘জোর করে দাহ করার নীতি’ গ্রহণ করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশের মুসলিম ও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের অধিকার বঞ্চিত করার জন্য ইচ্ছা করেই এই নীতি গ্রহণ করেছে তারা।” ২০০৯ সালে তামিল সম্প্রদায়ের সঙ্গে জাতিগোষ্ঠীগত সংঘাত শেষ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বিশেষ করে মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নানামুখী সংকটের মধ্যে পড়ে। বড় ধরনের দাঙ্গাসহ মুসলমানদের ওপর হামলা ও ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে ইস্টার সানডের বোমা হামলার পর মুসলমানদের ওপর হামলা-মামলা-আটকের ঘটনা আরো বাড়ে। এর সঙ্গে এবার যোগ হলো বাধ্যতামূলকভাবে লাশ দাহ করার বিষয়টি।
উল্লেখ্য, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে করোনাভাইরাস জীবন্ত কোষের ভেতরে বংশবিস্তারে সক্ষম, তবে দাফনের পর লাশ থেকে বের হয়ে মাটিতে বাঁচতে পারে না। লাশ যখন কবরে গলতে শুরু করে তখন ভাইরাস লাশ থেকে নির্গত তরলের সঙ্গে বের হয়ে আসে। তখন ভাইরাস যে ক্যাপসুলের মধ্যে থাকে তা আর টিকতে পারে না। আর যে ‘স্পাইক প্রটিন’ দিয়ে ভাইরাস ছড়ায় তা তার ক্যপসুলে থাকে। ফলে মাটিতে আসার পর ক্যপসুল না থাকায় ভাইরাসের পক্ষে আর সংক্রামক হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না।
এই ভাইরাসের আরএনএ তখন কবরের মাটি থেকে নিচে থাকা পানিতে মিশে যায়। এই পানি যদি কোনভাবে রিজার্ভের পানির সঙ্গে মিশে কোনো জীবন্ত মানব দেহে প্রবেশও করে তারা আর সংক্রমণ ছড়াতে পারে না। কারণ আগেই তাদের ক্যপসুল নষ্ট হয়ে গেছে।(সুরমা)