বিবি এন নিউজঃ বন্দর বাজার পুলিশ ফাড়ির কথা শুনলেই সবাই আৎকে উঠেন। নিরপরাধ মানুষ কে ধরে নির্যাতন করা হতো এই ফাড়িতে। চাদা সংগ্রহ করা হতো নিয়মিত। পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ এস আই আকবর ভুইয়া ছিলেন এর মুল নায়ক। আজ কবর থেকে রায়হানের লাশ তুলা হয়েছে কিন্তু আকবর কই? সবার প্রশ্ন- আকবর ভূঁইয়া কোথায়? পুলিশও জানে না আকবর কোথায়? সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হানের মৃত্যুর ঘটনার পর পরই গা-ঢাকা দেয় আকবর। তার আগে সে খুনের সব আলামত নষ্ট করে দেয়। এমনকি সিসিটিভির ফুটেজও মুছে দেয়া হয়। এ কারণে ‘গণপিটুনির’ কথা পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু যখন পার্শ্ববর্তী এসপি অফিসের সিসিটিভির ফুটেজে ঘটনা ধরা পড়ে তখন আকবরের সহযোগী এক পুলিশ সদস্য ঘটনা স্বীকার করে। ওই সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ৩টার পর সিএনজি অটোরিকশা যোগে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয় যুবক রায়হান উদ্দিনকে। রায়হান সিএনজি থেকে নেমে নিজেই হেঁটে হেঁটে পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে ঢোকেন। এ সময় তার হাতে হাতকড়া লাগানো ছিল।
ভোর সাড়ে ৬টার দিকে যখন রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয় তখন তার দুই হাত ছিল দুই কনস্টেবলের কাঁধে। পা ছেঁচড়ে সিএনজি অটোরিকশাতে তোলা হয় রায়হানকে। এ সময় বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর ভূঁইয়াও সেখানে ছিলেন। পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, ঘটনার দিন সকাল থেকেই লাপাত্তা ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর ভূঁইয়া। তাকে আর ফাঁড়ি এলাকায় দেখা যায়নি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। লাপাত্তা হওয়ার আগে সে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল- গণপিটুুনিতে গুরুতর আহত হলে রায়হানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। তখন সে ফাঁড়িতে নিয়ে আসার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু ঘটনা ছিল তার উল্টো। এ কারণে সিসিটিভির ফুটেজে সত্যতা পাওয়ার পর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা গতকাল সকালে মেট্রোপলিটন পুলিশ পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করে। তার আগে তিনদিন আলোচিত এ মামলার তদন্তে ছিলেন কোতোয়ালি থানায় এসআই আব্দুল বাতেন। আকবর ‘হাওয়া’ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ তার সন্ধানে নামে। গত সোমবার রাতে আকবরের আশুগঞ্জের বেড়তলা গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। এখন আকবর কোথায় আছে সেটি জানেন না পুলিশের কর্মকর্তারা। আকবর যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে দেশের সব ইমিগ্রেশন পুলিশকে বার্তা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে আকবর সম্পর্কিত অনেক তথ্য পুলিশের কাছে রয়েছে। আকবর ঘটনার দিন দুপুর পর্যন্ত সাদা পোশাকে ফাঁড়িতেই ছিল বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। ওই সময়ের মধ্যে সে ঘটনার সব আলামত নষ্ট করে ফেলে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। আকবরের এক বন্ধু ফাঁড়ির সিসিটিভির ওই ফুটেজ নষ্ট করে ফেলে। এমনকি হার্ডডিস্কও সরিয়ে নতুন হার্ডডিস্ক বসানো হয়। এ কারণে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিসিটিভির ফুটেজে কিছুই পাননি। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটির কাছে ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, আকবরের নেতৃত্বেই ধরে আনা যুবক রায়হানকে নির্যাতন করা হয়। সে সময় সাদা পোশাকে আকবর সেখানে ছিল। যখন রায়হানকে নির্যাতন করছিল পুলিশ সদস্যরা তখন আকবর নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যকে ‘বাহবা’ দেয়। ঘটনার দিন রাতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ রায়হানকে আটক করেছিল কাস্টঘরের সুইপার কলোনির একটি ঘর থেকে। এরপর লোকজনের সামনেই তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসা হয় থানায়। থানায় নিয়ে আসার পর ১০ হাজার টাকার জন্য তার পায়ের নখ উপড়ে ফেলাসহ নানা নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের সময় ফাঁড়ির ভেতর থেকে চিৎকারের শব্দ শুনতে পান প্রতিবেশীরা। রায়হানের চিৎকারে পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লাহ রেস্ট হাউজের বাসিন্দারা সেই চিৎকার শুনেছেন।
বেপরোয়া এসআই আকবর: প্রায় এক বছর আগে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এসআই আকবরকে। টগবগে এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা। ফাঁড়ির ইনচার্জ হয়ে যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সে। কারণ বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি আয়ের অন্যতম উৎস। ফাঁড়িতে যোগ দিয়েই এসআই আকবর তার পছন্দের পুলিশ সদস্যদের বদলি করে নিয়ে আসেন।
পুলিশের চাকরির চেয়ে তার কাছে ইউটিউব নাটকে অভিনয় করা ছিল নেশা। ‘গেইমওভার’ নামের সিলেটের আঞ্চলিক নাটকে অভিনয়ও করে। দিনে ফাঁড়িতে খুব কম সময়ই থাকতো আকবর। তবে সন্ধ্যার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত সে থাকতো। বন্দর এলাকায় একটি ছিনতাই গ্রুপ রয়েছে। সেই ছিনতাই গ্রুপকে লালন করতো আকবর। হকারের কাছ থেকে টাকার ভাগ আদায় করাতো পুলিশকে দিয়ে। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বন্দরবাজার, সুরমা পয়েন্ট থেকে হকার উচ্ছেদে বারবার অভিযান চালালেও আকবর হকারদের বসিয়ে দিতো। এবং প্রতিদিন হকারদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হতো। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে বসেই সেই টাকার লেনদেন হতো। শিলং তীরের একটি আস্তানা রয়েছে বন্দরবাজার এলাকায়। কাস্টঘর, লালদিঘীর পাড়সহ কয়েকটি এলাকায় মাদকের হাট ছিল। এসব হাট থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা আদায় করতো বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রায় সময় নগরীর লালবাজারের হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেন। তার অভিযানে হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপের নানা চিত্র ধরা পড়েছে। কিন্তু বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ছিল চুপ। নগরীর সুরমা মার্কেটে দু’টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব আবাসিক হোটেলে পুলিশের ডিসি আজবাহার আলী শেখ প্রায়ই অভিযান চালাতেন। কিন্তু এসআই আকবরের শেল্টারে হোটেলে আবার অসামাজিক কাজ শুরু হয়। সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পোস্টিং ছিল আকবরের জন্য সোনায় সোহাগা। সে ওই ফাঁড়িতে যোগদানের পর দুই হাতে টাকা আয় করতে থাকে। এ কারণে নিজ বাড়ি আশুগঞ্জে গড়ে তুলেছে প্রাসাদসম বাড়ি। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সে বাড়ির চেহারা পাল্টে দিয়েছে।