ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা মানুষ বোধ-বুদ্ধি যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি দ্রুত। হারাচ্ছি ঔচিত্যবোধও। মানুষ হিসেবে কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়, এ জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে নির্বোধ পশু আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মানুষের ইলাহ কে, কোন ঐহিক নির্দেশনা মানুষের গ্রহণীয়? নাকি মানুষ নিজের গড়া কোনওকিছুর সমীপেই মাথা লুটিয়ে দেবে চিরকাল? এমন ঔচিত্যবোধ মানুষের অনিবার্যরূপেই থাকা চাই। অন্যথায় মানুষ আর পশুতে তেমন কোনও ফারাকই থাকে না।
ইন্নাদ দীনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম।’ -সুরা ইমরান : আয়াত ১৯ এর প্রথমাংশ।
অর্থ : নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ‘দীন’। দীন শব্দের বাংলা অর্থ হলো জীবনশৈলী। জীবনব্যবস্থা। জীবনাদর্শ। জীবনাচরণ। জীবনবেদ। ইংরেজিতে ‘কোড অব লাইফ’। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাঙালি মুসলিমদের কাছে আল্লাহর দীনকে উপস্থাপন করা হলো ‘ধর্ম’ হিসেবে। যার ইংরেজি অনুবাদ ‘রিলিজিয়ন’। ধর্মের ইংরেজি অনুবাদ রিলিজিয়ন হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু ধর্ম হচ্ছে মানবপ্রণীত। যেমন: সনাতনধর্ম। বৌদ্ধধর্ম। জৈনধর্ম। শিখধর্ম। এগুলো সবই মানবপ্রণীত। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাচেতনাপ্রসূত। মানুষকে শৃংখলিত ও সমাজবদ্ধ করতেই এসব মতাদর্শের প্রবর্তন করেছেন একশ্রেণির বুদ্ধিমান মানুষ। এসবের মধ্যে কোনও ঐশী বা ঐহিক কারুকাজ ও কলাকৌশল নেই। যেসব ব্যক্তি এ মতাদর্শসমূহ প্রবর্তন করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই প্রাতঃস্মরণীয় এবং বরণীয়। এটা স্বীকার করতেই হবে। তবে তাঁরা কেউ আল্লাহর সমতুল্য নন।
পক্ষান্তরে দীন তথা বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ জীবনদর্শন ইসলামের বাণী মহান আল্লাহর তরফ থেকে যুগে যুগে নাযিল হয়েছে। যার পরিপূর্ণতা ও পরিসমাপ্তি ঘটে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর প্রতি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে অবতীর্ণ হবার মাধ্যমে। আর তা হচ্ছে সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কুরআন। এর শুরু থেকে শেষ অবধি কোনওপ্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি নেই। এতে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে: জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহ; হুদাল্লিল মুত্তাকিন। অর্থাৎ: এটি এমন এক কিতাব, যাতে কোনওরূপ বিভ্রান্তি নেই; এটি সৎ মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। -বাকারা : আয়াত ২।
সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার এ কিতাব আল কুরআনে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে ‘দীন’ শব্দটি। এর সঙ্গে আমাদের ঈমান-আকিদার বিষয় সম্পর্কিত। কিন্তু এটির স্থলে ভারত উপমহাদেশের একটি মৃতপ্রায় সংস্কৃতভাষার শব্দ ‘ধর্ম’কে আমরা বদলে নিয়েছি। নির্দ্বিধায় আল্লাহর শেখানো কুরআনের শব্দটি দূরে ঠেলে ফেলে মুশরিকদের ব্যবহৃত ‘ধর্ম’কে আত্মীকরণের ধৃষ্টতা প্রদর্শনের দুঃসাহস করছি।
রমযানে এক মহফিলে আমি এ প্রসঙ্গটি সামান্য উপস্থাপন করি। কিন্তু বিশিষ্ট আলেম মুহতারম মুফতি কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহিম আমার বিরোধিতা করলেন। কিন্তু আল্লাহর দীনকে মানবপ্রণীত ‘ধর্ম’ এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যে মুফতি সাহেবদের জন্য আত্মঘাতী তা কে বোঝাবে? উল্লেখ্য, হাজার হাজার আরবি তথা কুরআনের শব্দ বাংলাভাষায় অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। অনেক বাঙালি অমুসলিমও সেগুলো অবলীলায় ব্যবহার করছেন। কোনও সমস্যা হচ্ছে না শতাব্দের পর শতাব্দ ধরে। যেমন : আইন, আদালত, হাকিম, হুকুম, উকিল, মুক্তার, এজলাস, দহলিজ, মজলিস, আমল, আখলাক, এখলাস, খালিস, কবুল, মসজিদ, সিজদা, ইবাদত, হাজির, নাজির, কুদরত, রহমত, বরকত, হিফাজত, দাওয়াত, শরিফ, গরিব, মহব্বত, মাহবুব এরকম আরবি শব্দ আমরা সবাই প্রতিদিন ব্যবহার করি। কারুর কোনও সমস্যা নেই। আপত্তি নেই। প্রোবলেম কেবল ঈমান-আকিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘দীন’ শব্দটির ব্যবহারে। কিন্তু কেন?
আসসালামু আলাইকুম’ এবং এর জবাবে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’ মুসলিমরা সবাই বলেন। এমনকি অমুসলিমদের অনেকেই সালাম শিখে নিয়েছেন। তাঁরা নিজস্ব ধর্মভিত্তিক অভিবাদন নমস্কার, নমস্তে, গুডমর্নিং, গুড আফটারনুন, গুডবাই ইত্যাদি ভুলে আরবি ভাষার সালাম-কালামে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এমনটি দেখেছি আমি ভারতের কলকাতা, দিল্লি, লক্ষেèৗ, ভুপাল, জৌনপুর, এলাহাবাদেও। মাঝে মাঝে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতেও আরবি সালাম-সংস্কৃতির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আমাদের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী এমনকি কোনও কোনও আলেমকেও দীনের পরিবর্তে ধর্ম বলতে দেখা যায়। এটা যে আত্মঘাতী প্রবণতা তা আমাদের অনেকের বোধেই আসছে না। এমনকি একটি মহল মুসলিমদের ঈমান-আখলাক কেন্দ্রিক শব্দসমূহ চতুরতার সঙ্গে ভুলিয়ে দিয়ে একটি প্রতিবেশী দেশের শব্দমালার অনুপ্রবেশ ঘটাতে তৎপর তা আমরা অনেকে এখনও বুঝতেই চাই না। আমরা ঔদার্য আর মহানুভবতা দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ অর্জন করতে চাই। এর ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তাও করি না।
আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর খবর পাঠকরা ‘আল্লাহ’ শব্দটা প্রায়ই বিস্মৃত। আল্লাহর স্থলে পড়া হয় ‘সৃষ্টিকর্তা’, প্রভু, ওপরওয়ালা। ‘খালেক’ শব্দের অর্থ সৃষ্টিকর্তা হলেও আল্লাহর সমকক্ষ নয়। স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু এগুলো আল্লাহর গুণবাচক নাম। কিন্তু ‘আল্লাহ’ হচ্ছে জাতনাম। এবসিল্যুট নেইম। আর কোনও ভাষায়ই আল্লাহর অনুবাদ করা যায় না। হয় না। কিন্তু এ ‘আল্লাহ’ বাদ দিয়ে ‘সৃষ্টিকর্তা’ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে। একটি টিভি চ্যানেলে অভিনেতা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রবক্তা ইলিয়াস কাঞ্চনও আল্লাহর স্থলে ‘সৃষ্টিকর্তা’ চালিয়ে দিলেন অবলীলায়। এসব কারা করাচ্ছেন, কেন এবং কোন সাহসে করছেন? সেসব কারণ খতিয়ে দেখা জরুরি বৈকি। আল্লাহর স্থলে ‘সৃষ্টিকর্তা’ এবং দীনের জায়গায় ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠার মিশন বা দুরভিসন্ধি নিয়ে কাজ হচ্ছে বহুদিন থেকে। এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ও সাংস্কৃতিক হেরিটেজের সঙ্গে যারা বৈরী আচরণ করছেন, তাঁদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অন্যথায় এখনও কেউ কেউ আল্লাহ ও রাসুল (স) এর নাম দুয়েকবার মুখে উচ্চারণ করতে পারছেন। ভবিষ্যতে তা দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে।
তবে এদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রায় ৯০ শতাংশ। এদের মধে কেউ কেউ দীনপালন সম্পর্কে যথেষ্ট উদাসীন হলেও মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স) এর কোনওভাবেই অমর্যাদা করেন না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর নবী (স) কে নিয়ে অমর্যাদাকর কিছু করলে তাঁরা জান কুরবান করতেও দ্বিধা করেন না। যেকোনওভাবে কেউ কুরআন কিংবা দীনের প্রতি সম্মানহানি করতে উদ্যোগী হলে ইবাদত-বন্দেগিতে উদাসীনরাই আল্লাহর দুশমনদের রুখে দাঁড়ান নির্দ্বিধায়। এটা দীনের পক্ষে পজিটিভ একশন। কাজেই দীনের পরিভাষা এদেশ থেকে মুছে ফেলা খোলামুকুচি নয় আদৌ। এদেশের লাখ লাখ মসজিদে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত আযান প্রতিধ্বনিত হয়। ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আওয়াজ শোনা যায়। ভোরের আযানে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা ও কালেমার সুললিত সুরলহরির ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয় শ্যামল বাংলার আকাশ-বাতাস, সেখানে আল্লাহর নাম মুছে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, স্রষ্টা প্রভৃতি খণ্ডিত শব্দসমূহ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা আমাদের বিস্মিত ও হতচকিত করে বৈকি।
তওহিদ পরিপন্থী সংস্কৃতির সেবাদাস ও ভাড়াটে কর্মীদের জেনে রাখা উচিত, ‘আল্লাহ’ এর প্রতিশব্দ যেমন স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু বা খোদা নয়; তেমনই কুরআনের শব্দ ‘দীন’ এর প্রতিশব্দও ‘ধর্ম’ নয়। মানবপ্রণীত অনেক মতাদর্শকে ধর্ম বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে যুগে যুগে। শোষণ ও শাসন করা হয়েছে মানবসমাজকে অবলীলাক্রমে। কিন্তু আল্লাহর ‘দীন’ সেরকম কোনও মতাদর্শ নয়। এ দীন অবতীর্ণ মহান আল্লাহর তরফ থেকে হযরত মুহাম্মদ (স) এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার সার্বিক কল্যাণে। এ দীনের মধ্যেই সবমানুষের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত। কিন্তু দুর্ভাগা মানুষ সীমিত জ্ঞানবুদ্ধির কারণে সত্য-ন্যায়ের শাশ্বত আদর্শ ভুলে বিভ্রান্তিকর মরীচিকার পেছনে ধাবমান। এ উপলব্ধি আমাদের এখন জরুরি। আর কতো অদ্ভুত গাধার পিঠের আরোহী হয়ে ধাবিত হতে থাকবো সৃষ্টির সেরা আমরা এই মানুষ! আমাদের বোধ-বুদ্ধি হবে কবে