কয়েক দিন আগে সৌদিআরব থেকে বন্ধুবর এস আর সাইফুল সাহেব ফোনে বললেন, নিক্সন সাহেব আজকাল নেতাদের নামের পূর্বে হরেকরকম উপাধী দেখে তো মাথা আউলা ঝাউলা হবার অবস্থা। আসলে তারা কর্মী বান্ধব নেতা নাকি নেতা বান্ধব কর্মী?? প্লিজ এই ব্যাপারে আপনার একটা লিখা আশা করছি।। তাই আজকের এই দীর্ঘ লিখা।
আসলে নেতাদের নামের পূর্বে তাদের অর্জিত খ্যাতি সংযোগের ইতিহাস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত। মহাত্মা,কায়েদে আজম,পন্ডিত, বঙ্গবন্ধু, বাংলার রাখাল রাজা, বাংলার বাঘ,দেশবন্ধু, মজলুম, কমরেড,বিপ্লবী,বাঘা,মহান শিক্ষক সংগ্রামী,এই জাতীয় সম্মান জনগন কতৃক- ই তারা ভূষিত হয়েছিলেন। নেতাদের জীবনের সমগ্র জীবনীর সারসংক্ষেপ বৈশিষ্ট তাদের নামের খ্যাতির সাথে যুক্ত হয়ে জীবনকে আলোকিত করেছিলো।
সমকালীন রাজনীতিতে নেতার নামের পূর্বে মেধাবী,কর্মী বান্ধব,জননেতা,জনদরদী,রাজপথ কাঁপানো,একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী,প্রতিপক্ষের আতংক, স্বৈরাচারের আতংক, ইত্যাদি নামে ভূষিত করা হয়। নেতাদের উপাধী প্রাপ্তিতে সন্মতি থাকায় কর্মীরা আরো বেশী বেশী উপাধী সংযোজিত করে নেতাকে পুলকিত করার চেষ্টা করেন। যদিও এই সকল উপাধির গুনাগুন সম্পর্কে অধিকাংশ নেতা ও কর্মী দুই পক্ষের কাহারো কোন সত্য ধারনা থাকে না। মানুষ কোন নেতা বা গুরুত্বপূর্ণ লোককে দ্রুত সনাক্ত করার সুবিধার্থে তাদের অখ্যাতিকেও খ্যাতিসম্পুর্ন নামে সম্বোধন করে থাকে। মুরগী মিলন,ঠ্যেডা খালেক, ব্যাঙাকামাল,কসাই আবু, ডোম আব্দুল্যা, কালা জাহাঙ্গীর, কান কাটা জব্বর, গাল কাটা ছক্কু, বাোবা ডাকাত, ইত্যাদি নামে নামকরন করে থাকেন। অনেক চেষ্টা করেও কুখ্যাতিপূর্ন নাম পরিবর্তন করতে পারেন না।
‘কর্মী বান্ধব নেতা ‘এই এই উপাধি খ্যাতি এবং কুখ্যাতি ছাড়া মাঝামাঝি একটি বিশেষণ। যেই নেতা কর্মীদের আপদে-বিপদে এগিয়ে আসে এবং কর্মীদের ন্যায়-অন্যায় সকল কাজে সহযোগীতা করে তারাই কর্মী বান্ধব নেতা। কর্মীদের আশ্রয়স্থল হিসাবে যেই নেতা পরিচিত সেই নেতাই কর্মীবান্ধব। সকল কর্মী সকল নেতার কাছে সমান ভাবে সমাদৃত নয়। যেই নেতা তার নিজস্ব ভাবধারায় নিজস্ব বলয়ে নিদৃষ্ট কিছু সংখ্যক কর্মী উঠাবসা করে শুধুমাত্র তাদেরই বান্ধব হলেই সে কর্মী বান্ধব নেতা নয়। যিনি দলীয় আদর্শের ভাবধারায় সার্বিক সকল কর্মীকে সমান ভাবে দরদী আশ্রয়ে বেষ্টিত করে রাখেন তিনি কর্মী বান্ধব। নেতাকে ঘিরে থাকা গৃহপালিত ফলোয়াররা যেমন কর্মী নয় তেমনী নিজ অনুগত শ্রেনীর মাধ্যমে একটি গ্রুপ বেষ্টিত ব্যাক্তিও নেতা নয়।
একটি মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দলের আদর্শীক কর্মকান্ড দুই রকম বৈশিষ্টে দুই ভাগে বিভক্ত থাকে। বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ের দলীয় কর্মকান্ডের সাথে সরকারী দলে যাওয়ার পরের কর্মকান্ড একরকম নয়। বিরোধী দল থাকাকালীন সময়ে কর্মী বান্ধব নেতার মহত্ব অনেক বেশী। বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল জুলুম, নির্যাতন, নিপিড়নের সময়ে যেই নেতা কর্মীদের পাশে থেকে সঠিক সময়ে সঠিক স্বীদ্ধান্ত দিয়ে দলকে বহন (carry) করে প্রটেকশান দিতে সক্ষম এবং সাধ্যমত নিরাপত্তায় বেষ্টিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনিই কর্মী বান্ধব নেতা। যিনি কর্মীদের দুঃখে দুঃখী থাকেন তিনিই কর্মী বান্ধন। সাহার্য্য করার সামর্থ না থাকলেও যিনি সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম তিনি কর্মী বান্ধব।
ক্ষমতশীন দলের কর্মীদের উপর নেতার শক্ত প্রভাব থাকতে হবে। দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠীত হওয়ার পর নেতাকে তার অবস্থান পরিবর্তন করে কর্মী বান্ধবের পরিবর্তে জন বান্ধন চরিত্র ধারন করতে হবে। জনবান্দব নেতা থেকেই জন নেতা হিসাবে সমাজকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। নেতাকে কর্মীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে নেতা নিজে অপরাধ মুক্ত হতে হবে। কোন কর্মী অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়লে নেতা তাকে শাষন করার মত সৎ সাহস থাকতে হবে। নেতা নিজে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়লে নেতা-কর্মী দু’জনেই এক কাতারে সামিল হলে তখন দু’জনেই পরস্পরের বান্ধব হয়ে যায়।দলীয় দেশ প্রেমের মাধ্যমে আদর্শিক ভাবে দলকে জনগনের কাছে তুলে ধরতে হবে। জনগন দলের শত্রু নয় দলও জনগনের শত্রু নয়।
ক্ষমতাসীন দলের কর্মীগনের সাথে অনেক সময় জনগনের দুরত্ব সৃষ্টি হয়।দলের ভিতরে গনতন্ত্র ও দলীয় আত্মসমালোচনা না থাকলে দলীয় কর্মীগন সামাজীক অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়লে জনগন তাদের কাছ থাকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আদর্শ বিবর্জিত কর্মীগন দলের ক্ষমতার লিবার্টি ভোগ করার সুযোগে মাদক,ইভটিজিং,শালিশ বানিজ্য,চাঁদাবাজী, জমি দখল সহ অনেক সামাজীক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কোন নেতা সেই সকল অপরাধী কর্মীদেরকে বেআইনী ভাবে প্রটেকশন দেওয়ার চেষ্টা করলে সেই নেতা কর্মী বান্ধব হলেও জনগনের নিকট ধিকৃত হয়ে পড়ে। নেতা এবং কর্মী দু’জনে জনসমর্থন হারিয়ে ফেললে মানুষের মাঝে নিজ দল অপ্রিয় হয়ে পড়ে। সেই কারনে কোন কোন অঞ্চলে দলের চাইতে ব্যাক্তি জনপ্রিয় আবার কোন অঞ্চলে ব্যাক্তির চাইতে দল বেশী জনপ্রিয়।
মানুষ রাজনৈতিক আদর্শ ধারন করার জন্য কোন দলের গঠনতন্ত্র পড়ে সেই দলকে ভালোবাসে না। বাড়ির পাশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তির রাজনৈতিক দর্শন সেই এলাকার জনগনের উপর বেশী প্রভাব বিস্তার করে। দলীয় নেতা কর্মীদের আচরন ও পাবলিক ক্যারেকটার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জনগনকে অশান্তিতে রেখে, জনগনের জানমাল,ইজ্জত, হেফাজত না করে গনউপদ্রব সৃষ্টি করে জোর করে মত চাপিয়ে, কন্ঠরোধ করে জনসমর্থন আদায় করা যায় না। জবরদস্তি করে সাময়ীক স্বস্তি ভোগ করলেও স্থায়ীভাবে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে করতে পারে না। নেতা রাজনৈতিক বিষয়ে যেই পরিমান জ্ঞান রাখেন জনগনকে সেই ধারনা দিতে ব্যার্থ হলেই তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। যেই দল অগনতান্ত্রীক ভাবে জন্ম নিয়ে অনাদর্শিক জীবনদর্শন চাপিয়ে জনগনকে অন্ধকারে রাখতে চায়, যাদের দলের অর্জিত কোন আদর্শ নেই তারাই স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতা প্রদর্শন করচে চায়। যেই দলের ইতিহাস ঐতিয্যে ভরপুর সেই দল জনগনকে প্রতিপক্ষ করে রাজনীতি করতে পারে না।
গনতান্ত্রীক রাজনৈতিক দলের প্রধান শক্তি জনগন। জনমত ব্যাতিত গনতান্ত্রীক রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারে না। দলের কর্মীদেরকে আদর্শিক চর্চায় প্রতিনিয়ত সম্বৃদ্ধ করতে হবে। কর্মীদেরকে অনাদর্শিক কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার সুযোগ দিয়ে কর্মী বান্ধব নেতা হওয়ার মাঝে কোন গৌরব নেই। কর্মী বান্দব নেতা আর নেতা বান্ধব কর্মী তখনই কার্যকর হবে যখন উভয়ে জনবান্ধব হবে। বিশাল জনগোষ্টির জনমতের বিপরীতে কোন ক্ষুদ্রগোষ্টি টিকে থাকতে পারে না। রাজনীতির জন্য জনগনের শক্তিই বড় শক্তি। কর্মী বান্ধব নেতার চাইতে জনবান্ধব নেতা বেশী শক্তিশালী। বৃহত্তর জনগোষ্টিকে রাষ্ট্রের উন্নতি, সম্বৃদ্ধী ও ঘূর্ণায়মান প্রগতির সাথে সম্পৃক্ত করার দলীয় ব্যার্থতার দোষ জনগনের উপর চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যায় না। দলের ভীতরে দলীয় রেসপন্সসিবিলাইটি সৃষ্টি না করে ব্যার্থতা ট্রন্সফার করার সুযোগ নাই। ক্ষমতাশীন দলের নেতা কর্মী বেষ্টিত নিরাপদে থাকার নাম জনগনতান্ত্রীক রাজনীতি নয়। মানুষের ঘরে ঘরে রাজনীতির সুফল পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নেতা কর্মী দু’জনকে কর্মী বান্ধব মাইন্ডসেট পরিবর্তন করে জনবান্ধব মাইন্ড সেটআপ করতে হবে।
লেখক: নিক্সন চৌধুরী, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাক্তিত্ব, ওল্ডহ্যাম,যুক্তরাজ্য ।