সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সুনামগঞ্জ জেলা অফিস সূত্র জানায়, পুরো ব্রিজ বাস্তবায়নের কাজে ব্যয় হচ্ছে ১শ’ ৭২ কোটি টাকা। এছাড়া, সুরমা ব্রিজের সাথে চলাচলের জন্য গোবিন্দগঞ্জ থেকে ছাতক ও দোয়ারা সড়কে ১শ’ ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ৯টি ব্রিজের কাজ চলছে। এতে সুরমা পারের ৪ লাখ মানুষের স্বপ্ন পরিপূর্ণতা পাচ্ছে।
দীর্ঘ ১৬ বছর নানা জটিলতায় আটকে থাকা সুরমা ব্রিজ বাস্তবায়ন কাজ শেষের দিকে আসায় উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্পাঞ্চল ছাতকসহ সুনামগঞ্জের মানুষ আনন্দে ভাসছেন। ব্রিজটি নির্মাণের ফলে হাওরাঞ্চল সুনামগঞ্জে যোগাযোগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার একাংশ, দোয়ারাবাজার উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও ছাতক উপজেলার উত্তর পাড়ের দু’টি ইউনিয়ন, পৌরসভার একাংশ, ছাতক সিমেন্ট কারখানা ও লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরীসহ মেঘালয়ের পাদদেশের এ এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বর্তমান আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সময়ে ছাতকের সুরমা নদীতে ব্রিজ না হওয়ায় পুরোপুরি বিকশিত হতে পারছে না এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি এ এলাকায় শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার অপার সম্ভাবনা থাকলেও সড়ক পথে যোগাযোগের অভাবে গড়ে উঠছে না নতুন শিল্প কারখানা। এছাড়া, উত্তর সুরমার প্রায় ৪ লাখ মানুষ যোগাযোগের অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ছাতক-দোয়ারাবাজার নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক জানান, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্পাঞ্চল বলা হয় ছাতককে। আর ছাতকের শিল্পাঞ্চল হিসেবে খ্যাত সুরমা নদীর উত্তরাঞ্চল। ছাতকে সুরমার উত্তর পাড়ে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কারখানা। যা এখন ছাতক সিমেন্ট কারখানা নামে পরিচিত। পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরী। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ অঞ্চলে চুনাপাথর সহ অসংখ্য খনিজ সম্পদ রয়েছে। যা যোগাযোগের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ অঞ্চলের সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশে ছাতক সুরমা ব্রিজ ও দোয়ারাবাজারের মুক্তিযোদ্ধা ব্রিজ নির্মাণ ছিলো-এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবী।
১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে ৭১ বিধিতে গৃহীত নোটিশে ছাতকে সুরমা নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের জন্য সংসদের স্পীকার হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক। স্পীকার এমপি মানিককে ৭১ বিধিতে গৃহীত নোটিশে কথা বলার সুযোগ দিলে তিনি শিল্পনগরী ছাতকে সুরমা নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের গুরুত্বের উপর বক্তব্য দেন। এসময় যোগাযোগমন্ত্রী সংসদে কথা দেন ছাতকের সুরমায় ব্রিজ হবে।
এরপর বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। জোট সরকারের শেষ মেয়াদে ছাতক সুরমার উপর ব্রিজ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। এ সময় একটি প্রকল্প থেকে কিছু টাকা ব্যয় করে নদীর উপর চারটি পিলার তৈরী করা হয়। তড়িগড়ি ও পরিকল্পিতভাবে ব্রিজের এ্যাপ্রোচ ও নেভিগেশন ব্যবস্থা না থাকায় ব্রিজ নির্মাণে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এরপর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে ব্রিজটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে ওই বছরের ২৩ আগস্ট ব্রিজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর সরকারের একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সালে জানুয়ারীতে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছিলো এ সেতুটির কাজ। সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিলো তিন বছর। শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটির চারটি স্তম্ভ (পিলার) নির্মাণ করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রকল্পটি এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) থেকে বাতিল করা হয়। ২০১০ সালে এ সেতুটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ৫১ কোটি টাকার একটি নতুন সংশোধিত প্রকল্প যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। এই আবেদনের পরে আবার নতুন করে ২০২০ সালে ১১৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেকে) ১১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরমা সেতুর পুন:নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে। এরপর নেভিগেশন, এ্যাপ্রোচ, ভূমি অধিগ্রহণসহ দফায় দফায় কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন করে মোট ১শ’ ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রিজটি যোগাযোগের উপযোগী করে তুলা হয়েছে।
এমপি মানিক বলেন, শিল্প নগরী ছাতক পৌর শহরের বাজনা মহল ও নোয়ারাই ইউনিয়নের বারকাপন এলাকায় নদীর উপর কোন পরিকল্পনা ছাড়াই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য বিএনপি চারটি পিলার খাড়া করে। না ছিলো ব্রিজের নীচ দিয়ে কার্গো চলাচলের নেভিগেশন পরিকল্পনা, যোগাযোগের জন্য ৪ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ সড়ক এবং ভূমি অধিগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা ছিলনা। এসব জটিলতা সমাধান করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ব্রিজটি করা হয়েছে।
গতকালের উদ্বোধনী সভায় সওজ সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহা জানান, গুরুত্বপূর্ণ এই ব্রিজটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নতুন করে অনেক কিছু করতে হয়েছে। সর্বশেষ ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হওয়ায় শেষ পর্যায়ে এসেও ব্রিজটির পরিপূর্ণতা আটকে যায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা সমাধান করে বর্তমানে ব্রিজটি পরিপূর্ণতা পাচ্ছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীর প্রতিক জানান, সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে দোয়ারা বাজারের সীমান্ত এলাকায় যে সবজি চাষ হয়, তা কেবল সিলেটের চাহিদা পূরণ করবে না ; এ সবজি বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব। কিন্তু, যোগাযোগের অভাবে অধিকাংশ সবজি নষ্ট হয়ে যায় এবং এসব সবজি কৃষকদের পানির দামে বিক্রি করতে হয়। ছাতকের ব্রিজ নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ৫নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার হকনগর (বাঁশ তলা) অপরুপ সৌন্দর্য্য দেখতে দেশ বিদেশের পর্যটকদের ঢল নামবে।
ছাতকে সুরমা ব্রিজ বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি এডভোকেট আশিক আলী জানান, উত্তর ছাতকে শুধু ছাতক সিমেন্ট ও লাফার্জ সিমেন্ট ফ্যাক্টরীই নয়, এখানে সোনালী চেলায় ইছামতি শুল্ক স্টেশন রয়েছে। ছাতকের ইসলামপুর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মিত হচ্ছে। এছাড়া, উত্তর ছাতকে ব্যবসার জন্য সম্প্রতি সৌদি আরবের আল রাজি গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারের সাথে দু’টি বড় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তারা প্রতি বছর ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর মাধ্যমে ১৫ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন করবে এবং এখানে ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করবে। ছাতক সুরমার ব্রিজ নির্মাণের ফলে উত্তর ছাতক সিলেট তথা বাংলাদেশের সেরা শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে।(সিলেটের ডাক)